স্কুল-কলেজে পড়ার সময়টায় অনেক ছোট খাটো সাধ আহ্লাদ অপূর্ণ থাকলেও একটা জিনিসে আমার আব্বার টাকা খরচ করার কোন লিমিট ছিলো না- সেটা হলো আমার কোচিং আর ঘরের টিচারদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে! বাকি সব কিছু নিয়ে টানাটানি থাক- সব স্যারদের বেতন কিভাবে কিভাবে যেন উনি ঠিকই মাসের শুরুতেই ম্যানেজ করে ফেলতেন, কিন্তু এখানেই শেষ না। প্রতিটা দিন পড়াতে আসার পর আম্মু খুবই যত্ন করে নিজের হাতে নতুন নতুন মজার মজার আইটেম নাস্তা বানিয়ে স্যারদের খাওয়াতেন- কারণ একটাই, স্যাররা যাতে একটু এক্সট্রা কেয়ার নিয়ে মন থেকে আমাদের পড়ান। এ্ত আন্তরিকতার ফলাফল যেটা হলো, উনারা আর যাস্ট টিউটর রইলেন না, মোটামুটি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেলেন। আমাদের পড়ানো শেষ করার বহুবছর পরও উনারা নিয়মিত আমাদের বাসায় আসেন, আব্বু-আম্মুর সাথে গল্প টল্প করেন। আমার ফ্রেণ্ডলিস্টে আমার স্কুল লাইফের দুইজন টিউটর আছেন, উনাদের সাথে আমার সম্পর্কটা ছাত্র-শিক্ষকদের চেয়েও অনেক বেশি। অথচ পরবর্তীতে নিজে টিউটর হয়ে পড়াতে গিয়ে কিংবা বন্ধু বান্ধবের মুখে শুনেছি এমন অনেক গার্জিয়ানের কথা যারা টিচারদের টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া স্লেভের মত দেখেন, নাস্তা টাস্তা কোন রকম চা বিস্কুটদিয়ে চালিয়ে দেবার ট্রাই করেন এবং পড়ানোর সময় এসে ছোঁকছোঁক করতে থাকেন। এরকম সন্দেহ পূর্ণ আচরণ, অবিশ্বাস- এসবের মধ্যে বসে কি আদৌ কারও ভেতর থেকে আন্তরিকতা নিয়ে পড়ানোর আগ্রহ হবে?
.
"হাউজ অফ কার্ডস" নামে একটা ইংলিশ টিভি সিরিয়াল হয় নেটফ্লিক্সে, সেখানে দেখায় কিভাবে একজন পলেটিশিয়ান নানা রকম কাল-কাঠি নেড়ে, মানুষে মানুষে ঝামেলা লাগিয়ে দিয়ে নিজে ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে থাকে। এবং এই কাজটা করার সময় তার কিছু বিশ্বস্ত মানুষ লাগে যাদের একশ ভাগ বিশ্বাস করা যায়। এখন, মানুষের লয়ালিটি কি টাকা দিয়ে কেনা যায়? না! দেয়ার উইল বি অলয়েস সাম-ওয়ান উইথ মোর মানি দ্যান ইউ- লয়ালিটি কিনতে হয় ভালোবাসা আর সম্মান দিয়ে! সিরিয়ালটার মেইন ক্যারেক্টার তার খুব কাছের মানুষগুলার লয়ালিটি কিনেছিলো তাদের প্রশংসা করে, তাদের উপর আস্থা আছে, কনফিডেন্ট নিয়ে- ভয়, ভীতি, টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে না! তারা জীবন দিয়ে সেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়েছে।
.
আমাদের দেশে কিছু টিচার আছেন যারা ছাত্রদের মনোবল ভেংগে মজা পান। অপমান করে পৈশাচিক আনন্দ লাভ করেন। একটা ছাত্র, যার কিনা গড গিফটেড মেধায় সামান্য ঘাটতি আছে, কিন্তু সে পরিশ্রম করতে চায়- এমন একজনকে যদি সামান্য ভুলের জন্য তার টিচার কুৎসিত মুখভংগি করে বলে- "তোরে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তোর মাথা ভর্তি গোবর, এসব পড়াশুনা করে বাপের টাকা নষ্ট না করে গ্রামে গিয়ে হাল চাষ কর!!" তাহলে ঐ ছাত্রটার মনোবল বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে? না তার আরেকবার ট্রাই করার ইচ্ছা হবে? অথচ এই ছেলেটাকেই যদি মাথায় হাত বুলিয়ে বলা হতো, "আমি জানি তুই পারবি, আরেকটু কষ্ট কর, এসব একদম সোজা... তুই এক বারের জায়গায় দুইবার প্র্যাকটিস করলেই একদম ডাল ভাত হয়ে যাবে... তাতেও না হলে আরেকবার করবি... কিন্তু তুই পারবিই, আমি জানি!!"- এই কথা টুকু বললে ছেলেটার বুকের ভেতর কি পরিমাণ সাহস আর উৎসাহ আসবে চিন্তা করা যায়? সে তখন অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলতে পারবে!!
.
কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা পোস্টে দেখেছিলাম- কোন এক কোম্পানিতে নতুন মালিক আসার পর তারা কর্মচারী শ্রমিকদের বেতন বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দেয়, সাথে আরো অনেক সুযোগ সুবিধা, কোম্পানির খরচে বছরে একবার ট্যুরের সুযোগ। এর ফলাফল কি হয় জানেন? দুই মাসের মাথায় ঐ কোম্পানির মুনাফা দ্বিগুন হয়ে যায়! আপনি আপনার শ্রমিকদের যা দিবেন, তারা তার কয়েকগুন বাড়িয়ে দিবে। শ্রমিকের মজুরি মেরে, তাদের সাথে অন্যায়-অত্যাচার করে কোম্পানি বাঁচানো যায় না।
.
একই কথা খাটে সম্পর্ক গুলোর ক্ষেত্রেও। কারো পক্ষে কখনও একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না তার প্রেমিক বা প্রেমিকা্র মাথায় আসলে কি চলছে সেটা জানার। হয়তো বাইরে বাইরে খুব ভালোবাসার অভিনয় করতে করতে, মুখে আলাভু আলাভু বলে ফ্যানা ছুটিয়েও আড়ালে তার মাথায় আরো অনেক কিছু আছে, হয়তো আপনার পাশাপাশি আরো কয়েকজনকে ঝুলিয়ে রেখেছে ব্যাক-আপ হিসেবে, আপনাকে ভালো আর না লাগলে, হঠাৎ আগ্রহ হারায় ফেললে বা কোন কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে যেন একা না হয়ে যেতে হয়। মানে একটু উড়ু উড়ু ভাব। হাতে নাতে ধরা খাওয়ার আগপর্যন্ত আপনি কখনই এসব ব্যাপারে এবসুল্যুটলি শিউর হতে পারবেন না। তাহলে কি করা যায়? তাকে আপনার প্রতি লয়াল হতে বাধ্য করা যায়। সেটা কিভাবে? সন্দেহবাতিকগ্রস্ত আচরণ করে? তার উপর গোয়েন্দা গিরি করে? তার উপর নজরদারি করে? তাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে? না!! এসব যারা করে তারা ভালো মানুষকেও খারাপ করে ফেলে। আপনাকে তাকে বিশ্বাস করতে হবে, তাকে তার মত চলতে দিতে হবে এবং তাকে সেটা বুঝতে দিতে হবে। "আমি জানি তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো এবং আমি চাইলেও তোমার মত ভালোবাসতে পারবো না- একদম মনের গভীর থেকে আমি সেটা টের পাই"- এই কথাগুলো কোন উড়ুউড়ু মনের মানুষকেও নাড়িয়ে দিবে, সে চাইলেও আর বিশ্বাস ভংগ করতে পারবে না- তার বিবেক এসে বাঁধা দিবে। আর নিতান্তই যদি বিবেকহীন প্রতারক টাইপের হয়, তবুও তার মনে একটু হলেও দাগ ফেলবে- একটা সত্যিকারের ভালো মানুষের বিশ্বাস ভেংগে ছিলাম আমি! উঠতে বসতে সন্দেহ করে, শাসন করে, সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে শুধু সম্পর্ক বিষিয়েই তুলা যায়, ঝগড়ার রসদ জুগানো যায়- বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। কারো নিঁখুত সম্মান, বিশ্বাস আর ভালোবাসা পেতে হলে তাকেও গভীর ভাবে সম্মান করতে হয়, টোটালি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে মন থেকে বিশ্বাস করতে হয়, তীব্র ভাবে ভালোবাসতে হয়। বাকি টুকু "নিয়তি" নামের কিছুর হাতেও তোলা থাকুক, তাতে যদি কেউ কষ্ট দিয়ে বিশ্বাস ভংগ করে চলেও যায়, আফসোস থাকবে না- অন্তত আমি তো আমার জায়গায় ঠিক ছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম। যে চলে গেছে লস তার- আমিই জিতে গেছি! :)
ভাষা বদলি করুন
May 31, 2016
মনের কথা
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
Popular Posts
-
।।জাকারিয়া ইছলাম।। প্রত্যেকেই তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু লাভের জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে থাকে। সম্পাদের জন্য যে লালায়িত সে তা অর্জনের নিমিত...
-
ক্যারিয়ার ব্যবস্থাপনা (ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপনাকে সহায়তা করবে।) ১. প্রশ্ন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে নিজেকে মূল্যায়ন: -----...
-
।। জাকারিয়া ইছলাম।। নবী মুহম্মদের ( ﷺ ) জন্ম মৃত্যু নিয়ে আমাদের ভন্ডামির শেষ নেই। নবীজির জন্ম মৃত্যু একই তারিখে হয়েছে বলে যে একটা প্...
No comments:
Post a Comment