ভাষা বদলি করুন

The Only way to stop any pain in your life is to accept the fact that nothing is yours, nothing was yours, and nothing will ever be yours. They are worldly attachments; given by Allah, belonging to Allah and returning beck to Allah.

June 03, 2016

বাঙালির ভাষা বা বাঙালির ভাষাতাত্ত্বিক পরিচিত ও ইতিহাস

বাংলা

বাঙালির ভাষার নাম বাংলা।

ইংরেজি : Bengali, Bangla।

 

প্রাগৈতিহাসিক ভাষা

প্রাগ্-ভাষা পরিবার : প্রাক ইন্দো-ইউরোপীয়

 ভাষা পরিবার : ইন্দো-ইউরোপিয়ান

ভাষা উপ-পরিবার :   ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষা

শাখা :

ভারতীয়-আর্য ভাষা

উপ-শাখা :

পূর্বাঞ্চলীয় আর্য ভাষা

ভাষাগোষ্ঠী :

বাংলা-অহমিয়া ভাষা

 

ভাষা সঙ্কেত‒

আইএসও ৬৩৯-১ bn,

আইএসও ৬৩৯-২ ben

আইএসও ৬৩৯-৩ ben

 

ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য ভাষা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা রাজ্য এবং আসামের কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির স্থানীয় ভাষা। এছাড়া বাংলা ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় ভাষা।  আফ্রিকার সিয়েরে লিওনের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়া ভারতের প্রায় সকল প্রদেশেই বাংলা ভাষাভাষীরা বসবাস করে। ভারতবর্ষের বাইরে মধ্যপ্রাচ্য, মায়ানমার, মালোয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইংল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে বিশাল সংখ্যক বাঙালি বসবাস করে।

বাংলা ভাষার ইতিহাস: আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষে আগত আদি নৃগোষ্ঠীকে বলা হয় নেগ্রিটো। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০০ বৎসর আগে বঙ্গদেশের মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বসবাস করতো। এরপর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠী।নেগ্রিটোদের সাথে  প্রোটো-অস্ট্রালয়েডদের রক্তের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল যে মিশ্র জাতি, ভাষাতাত্ত্বিকরা তাদের ভাষাকে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ভাষার বিচারে তাই এদেরকে কখনো কখনো অস্ট্রিক জাতি বলা হয়। প্রাচীন ভারতের বিশাল অংশ জুড়ে এই ভাষার মানুষ ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারে দেশী শব্দ হিসেবে যে সকল শব্দকে উল্লেখ করা হয়, তার একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা পরিবারের দুটি ভাষার শব্দ। এই ভাষা দুটি হলো‒ মুণ্ডারি এবং সাঁওতালি। সে সময়ের বাংলাদেশের মানুষের মূল ভাষাই ছিল এই দুই ভাষা কেন্দ্রিক।<p> </p>প্রোটো-অস্ট্রালয়েড নৃগোষ্ঠীর মানুষের আগমনের পর ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল  দ্রাবিড়রা। এদের প্রবেশ ঘটেছিল ভারতবর্ষের পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে। এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০-৩৫০০ বৎসরের ভিতরে বসতি স্থাপন করেছিল। তারপর এরা ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের সাথে অস্ট্রিক ভাষাভাষীদের সম্মিলনে ভারতবর্ষের ভাষায় আবার সংমিশ্রণের ধারা সচল হয়ে উঠেছিল। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে দ্রাবিড়দের বিস্তার যতটা প্রবলভাবে ঘটেছিল, বঙ্গদেশে ততটা ঘটে নি। ফলে এই অঞ্চলের ভাষায় অস্ট্রিক ভাষার আধিপত্য রয়েই গিয়েছিল।

খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দের দিকে আর্যরা ভারতবর্ষে আসা শুরু করেছিল। উত্তর-পশ্চিম ভারত দিয়ে এই আগত এই জনগোষ্ঠী খ্রিষ্টপূর্ব ১১০০ অব্দের দিকে বঙ্গদেশ পর্যন্ত পৌঁছেছিল। খ্রিষ্ট-পূর্ব ১০০০ বৎসরের ভিতরে ভারতীয় ইন্দো-ইরানিয়ান ভাষার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের ভিতরে এই পরিবর্তিত ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ঋগ্বেদ। ধারণা করা হয়- ঋগ্বেদের শ্লোকগুলো রচিত হয়েছিল খ্রিষ্ট-পূর্ব ১২০০-১০০০ বৎসরের ভিতরে। বিভিন্ন ঋষিদের রচিত বিভিন্ন শ্লোকগুলো একত্রিত করে যে সংকলিত গ্রন্থ প্রস্তুত করা হয়, তাই ঋগ্বেদ নামে পরিচিতি লাভ করে। এরপর লেখা হয় অন্য তিনটি বেদ এবং এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য গ্রন্থ। গোড়ার দিকে সকল বেদ সংকলিত হয়ে একটি বেদ-আকারে ছিল। বেদের এই ভাষাকে বলা হয় বৈদিক ভাষা।

বৈদিকভাষার যুগে আর্য ঋষিদের সাথে সাধারণ আর্যদের যতটা যোগাযোগ ছিল, কালক্রমে তা অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছিল। বৈদিক ভাষা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা না হয়ে সাহিত্যের ভাষা হয়ে উঠেছিল। এর ফলে বৈদিক ভাষার নানা ধরনের কথ্যরূপ তৈরি হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৫০০ অব্দের ভিতরে বৈদিক ভাষা থেকে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। ব্যাকরণ দিয়ে এই ভাষার রীতি নীতি অনেকে বাঁধার চেষ্টাও করেছিলেন অনেকে। এক্ষেত্রে পাণিনি সফল হয়েছিলেন। তাঁর সাফল্য সাময়িকভাবে বৈদিক ভাষাকে জীবন্ত করেছিল বটে, দীর্ঘজীবী করতে ব্যর্থ হয়েছে।

পাণিনি 'অষ্টাধ্যায়ী' নামক একটি ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৪০০ অব্দের দিকে। এই ব্যাকরণের সূত্রে বৈদিক সংস্কৃতি বিবর্তনের ভিতর দিয়ে একটি পরিমার্জিত ও পরিশীলিতরূপ লাভ করেছিল। পাণিনির পূর্বে বা সমসাময়িককালে সংস্কৃত ভাষার তিনটি কথ্য রূপ গড়ে উঠিছল।

প্রাচ্য : এই রূপটি প্রচলিত ছিল পূর্বভারতের অযোধ্যা, উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।উদীচ্য : উত্তর-পশ্চিম ভারত ও উত্তর পাঞ্জাব।মধ্যদেশীয় : পশ্চিম ভারতের মধ্যদেশ, দিল্লী, মীরাট, মথুরা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।

সুনীতি চট্টোপাধ্যায় ভারতের মহারাষ্ট্র অঞ্চলে সংস্কৃত ভাষার অপর একটি রূপ ছিল বলে অনুমান করেছেন। তিনি এর নাম দিয়েছেন দাক্ষিণ্যাত্য।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত  (মাওলা ব্রাদার্স, জুলাই ১৯৯৮) গ্রন্থে একটি সারণীতে আর্য ভাষার থেকে বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারায় যে তথ্য উপাস্থাপন করেছেন, সেই তথ্যানুসরণে নিচের তালিকাটি দেওয়া হলো।

ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষা (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৩৫০০-২৫০০)শতম (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ২৫০০-১২০০)আর্য (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ  ২০০০-১২০০)প্রাচীন ভারতীয় আর্য (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ১২০০-৮০০)আদিম প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৮০০-৫০০)প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (খ্রিষ্টপূর্বাব্দ ৫০০-২০০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পালিগৌড়ী প্রাকৃত (২০০-৪৫০ খ্রিষ্টাব্দ)গৌড় অপভ্রংশ (৪৫০-৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ)প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)সন্ধিযুগ (১২০০-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ)মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ)নব্যযুগ (১৮০০)

সংস্কৃত ভাষার প্রাচ্য  রূপটি প্রচলিত ছিল পূর্বভারতের অযোধ্যা, উত্তর ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিহার এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল।আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন 'ভারতীয়-আর্য ভাষা'র 'পূর্বাঞ্চলীয় শাখা'য় (প্রাচ্য) পৃথকভাবে বাংলা-অহমীয়া প্রাকৃত ভাষার সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রাকৃত রূপটি কি ছিল তা নিয়ে ব্যাকরণবিদের মধ্য মতবিরোধ আছে। যেমন  সুনীতিকুমার চট্টোপধ্যায়ের মতে: " মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে"। আর ড. শহীদুল্লাহর মতে: "গৌড়ীয় প্রাকৃত হতেই গৌড়ীয় অপভ্রংশের মাধ্যমে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে "। কিন্তু উভয়ই মনে করেন যে, বাংলা-অহমিয়া ভাষা ভাষাগোষ্ঠীই বিভাজিত হয়ে বাংলা এবং অহমিয়া নামক দুটি ভাষার জন্ম হয়েছে।

মূলত ভারতের বিবর্তিত আর্য ভাষার অন্যান্য শাখার মতোই পূর্বাঞ্চলীয় শাখার কথ্যরূপ, স্থানীয় অনার্য ভাষাভাষীদের সংমিশ্রণে গড়ে উঠছিল। কালক্রমে উভয়ের সংমিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল পূর্বাঞ্চলীয় প্রাকৃত ভাষা। বাংলা-অহমিয়া ভাষা হলো বাংলা ভাষার সর্বশেষ প্রাকৃত ভাষার একটি রূপ। খ্রিষ্টীয় ৫০০-৬০০ অব্দের দিকে বাংলা ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষায় রূপ নিয়েছিল।

ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের সূচনা হয়েছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায়েরভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ (রূপম, ১৩৯৬) গ্রন্থ মতে- খ্রিষ্টীয় ৬০০ অব্দের পরে প্রাকৃত ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যে রূপ লাভ করেছিল, সেই রূপটিই অপভ্রংশ। আর চর্যাপদের রচনাকালকে তিনি ৯০০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত বলে অনুমান করেছেন। তাঁর মতে এর আগে উত্তর বিহারের মৈথিলী, দক্ষিণ বিহারের মগহী, পশ্চিম বিহারের ভোজপুরিয়া, উড়িষ্যার উড়িয়া ও আসামের আসামী ভাষা মিলে একটি ভাষা ছিল। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় এর নামকরণ করেছেন মাগধী অপভ্রংশ। বাঙালী এই দুই প্রধান ভাষাতাত্ত্বিক ছাড়াও দেশী বিদেশী বহু ভাষাতাত্ত্বিক ভিন্ন ভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করেছেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দের পরের দিকে সংস্কৃত সাহিত্যিকরা প্রাকৃত ভাষার বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করতে পারেন নাই। তাঁরা প্রাকৃতভাষাকে অশিক্ষিতের ভাষা হিসাবে বিবেচনা করেছেন, কিন্তু সংস্কৃত সাহিত্যে তার নমুনাও হাজির করেছেন, সংস্কৃত নাটকে হাস্য-কৌতুকের ভাষা হিসাবে প্রাচীন মাগধী ভাষাকে ব্যবহার করেছেন। ভারতবর্ষের সকল প্রান্তের প্রাকৃত ভাষা একইভাবে বিকশিত হয় উঠে নি। ভাষার এই ব্যবধান লক্ষ্য করে পাণিনি প্রাকৃতভাষাকে প্রাচ্যাং ও উদীচ্যাং নামে চিহ্নিত করেছিলেন। স্থানীয় অনার্য ভাষা তথা প্রাকৃত ভাষার কালানুক্রমিক বিকাশের আদি অধ্যায় অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এই সংস্কৃতের সংস্পর্শে এসে প্রাকৃত ভাষার যে মিশ্ররূপ তৈরি হয়, তাকেই অপভ্রংশ ভাষা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যে কোনো ভাষার ক্রমবিবর্তনের ধারা জানতে গেলে, তার লিখিত বা শ্রবণ নমুনা দরকার। সে আমলের শ্রবণ নমুনা সংগ্রহের কোনো পদ্ধতি ছিল না। তাই সেকালের ভাষারীতি জানার জন্য প্রয়োজন পড়ে লিখিত নমুনা। এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষার সর্বপ্রাচীন যে নমুনা পাওয়া গেছে তা হলো- চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর মতে " আমি বাঙ্গালা সাহিত্যের আরম্ভ ৬৫০ খ্রীঃ অঃ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছি। নাথ-গীতিকার উদ্ভব বৌদ্ধযুগে। কিন্তু আমরা তাহা পাই নাই। আমরা বৌদ্ধযুগের একটি মাত্র বাঙ্গালা পুস্তক পাইয়াছি। ইহার নাম আশ্চর্যচর্যাচয়।" [বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮]। চর্যাগীতির রচনাকাল নিয়ে নানা পণ্ডিতের নানা মত আছে। বিভিন্ন গবেষকদের আলোচনার সূত্রে চর্যাপদের একটি কালসীমা নিতে পারি ৬০০-১২০০  খ্রিষ্টাব্দ। একটি ভাষায় কবিতা লেখার প্রান্তীক সময় যদি ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ ধরে নেই। তাহলে বুঝতে হবে ওই ভাষাটা আদি অবস্থা থেকে অন্তত কবিতা লেখার পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে অন্তত ১০০ বৎসর অতিক্রম করেছে। তাহলে বাংলা আদিরূপটি গড়ে উঠার জন্য ৫০০ অব্দ ধরে নেওয়া যেতে পারে।

বাংলা ভাষার ক্রমবিবর্তনের কালানুক্রমিক ধারা

চর্যাগীতি 'কে বাংলার প্রাচীন নমুনা হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে, তার পরবর্তী নমুনা অনুসারে বাংলা ভাষাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ।

প্রাচীন যুগ (৬৫০-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ): চর্যাগীতি  বা চর্যাপদের ভাষার নমুনা এবং প্রাচীনত্বের বিচারে প্রাচীন যুগকে চিহ্নিত করা হয়েছে। কালের বিচারে বলা যায়, ১২০০ খ্রিষ্টেব্দের পূর্বর্তী বাংলা ভাষার নমুনাসমূহকে প্রাচীন নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

অন্ধকার যুগ (১২০২-১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দ): চর্যাগীতি র  নমুনা পাওয়ার পর একটি দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার কোনো নমুনা পাওয়া যায় নি। এই সময়কে মোটা দাগে অন্ধকার যুগ বলা হয়। এই নমুনা না পাওয়ার কারণ হিসেব দেখিয়েছেন বঙ্গদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্থিরতা। এই সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধবিগ্রহ তথা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতবাহিত হয়েছে, তা এই সময়ের বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকালেই বুঝা যায়।

অন্ধকারযুগের বাংলা : এর সূচনা হয়েছিল ১২০২ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দীন বখতিয়ার খিলজি নদীয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে। নদীয়ার রাজা লক্ষ্মণসেন পালিয়ে জীবন রক্ষা করেন। এরপর তিনি বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করেন। বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরা এই সকল অঞ্চলে ব্যাপক হত্যা ও লুণ্ঠন করে। ফলে বহুলোক পুর্ববঙ্গ ও কামরূপে পালিয়ে যায়। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তিনি ধীরে পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গ দখল করে নেন। এরপর তিনি তিব্বত আক্রমণ করে জয়লাভ করলেও তার জন্য বিপর্যয় দেকে আনে। শেষ পর্যন্ত বখতিয়ার তার অনুচর আলী মর্দানের হাতে নিহত হন। এরপর বখতিয়ারে অপর অনুচর সিরান আলী মর্দানকে পরাজিত ও বন্দী করে করে ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। মর্দান পরে ছাড়া পেয়ে দিল্লীর রাজা কুতুব-উদ্দিন আইবেক-কে সন্তুষ্ট করে, বাংলার শাসনকর্তার পদ লাভ করেন। ১২১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বাংলায় এলে সিরান তার হাতে বাংলার ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। দিল্লীতে কুতুব-উদ্দীন মৃত্যুবরণ করলে, ১২১৩ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মার্দানকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। দিল্লীর সুলতান ইলতুৎমিস ১২২৫ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। গিয়াসউদ্দিন শান্তি চুক্তি করলে ইলতুৎমিস দিল্লীতে ফিরে যাওয়ার পর গিয়াসউদ্দিন দিল্লীর আনুগত্য অস্বীকার করেন। ফলে ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিসের পুত্র নাসিরউদ্দিনের কাছে পরাজিত ও সপরিবারের নিহত হন। এরপর ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিনের মৃত্যু হয়। এরপর বল্কা নামক এক সেনাপতি দিল্লীর আধিপত্য অগ্রাহ্য করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিশ বিদ্রোহী বল্কাকে পরাজিত করে হত্যা করেন। এই সময় আলাউদ্দিন-জনিকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ইলতুৎমিশ মৃত্যবরণ করেন। এরপর বিহারের শাসনকর্তা তুঘ্রাল-তুঘান খান, দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলার শাসনকর্তা আওর খাঁ আইবেককে পরাজিত করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। তিনি কৌশলে দিল্লীর সুলাতানা রাজিয়ার কাছ থেকে বাংলা শাসনের অধিকারও লাভ করেন। অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রে তুঘান খাঁ পদত্যাগ করেন এবং তার জায়গায় তমর খাঁ শাসনকর্তার হিসেবে নিয়োজিত হন। এরপর মুঘিশউদ্দিন উজবেক শাসনক্ষমতা লাভ করেন ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে। ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কামরূপ রাজার সাথে যুদ্ধে নিহত হন। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বলন দিল্লীর সিংহাসন লাভ করেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন আমিন খাঁ। আমির খাঁর সহকারী তুঘ্রাল খাঁ পূর্ববঙ্গে অভিযান চালিয়ে ঢাকা, ফরিদপুর অঞ্চল দখল করে নেন। পরে তিনি ত্রিপুরা দখল করেন। দিল্লীতে বলবন মৃত্যবরণ করেছে, এই মিথ্যা সংবাদের ভিত্তিতে তুঘ্রাল বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং আমিন খাঁকে বিতারিত করেন। ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুঘ্রালের বিরুদ্ধ বলবন অভিযান পরিচালনা করেন। যুদ্ধে তুঘ্রাল বন্দী হন। পরে বলবন তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেন। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বলবনের পুত্র বঘরা খাঁ দিল্লীর প্রতিনিধি হিসেব বাংলা শাসন করেন। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বলবন মৃত্যবরণ করলে, বঘরা খাঁ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঘরা খাঁ'র উত্তরাধিকাররা বাংলাদেশের স্বাধীন সুলতান হিসেবে নির্বিবাদে রাজত্ব করেন। ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর সুলতান গিয়াঢসউদ্দিন তুঘলক বাংলা আক্রমণ করে, তৎকালীন বাংলার সুলতান বাহাদুরকে পরাজিত করেন। বাহাদুর শাহকে প্রথমাবস্থায় গিয়াসউদ্দিন দিল্লীতে নিয়ে যান। পরে বাংলার শাসন ব্যাবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য বাংলার শাসনকর্তা বহরম শাহ সহযোগী হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু বাংলা ফিরে বাহাদুর পুনরায় বাংলার অধিকার লাভ করার চেষ্টা করলে, বহরম শাহ তাঁকে হত্যা করেন। এই সময় বাংলদেশ লক্ষ্ণণাবতী, সাতগাঁ এবং সোনারগাঁও নামে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে বহরম শাহ্ মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় ফকরুদ্দিন নামক এক সেনাপতি সোনারগাঁও থেকে নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেব ঘোষণা দেন। ফলে লক্ষ্ণণাবতীর শাসক কাদর খাঁ ও সাতগাঁও-এর শাসক ইজউদ্দিন যৌথ আক্রমণ করে ফকরুদ্দিনকে বিতারিত করেন। এই সময় কাদর খাঁ দিল্লীর প্রতিনিধ হিসেব লক্ষ্ণণাবতী ও সোনারগাঁও শাসন করেন। এক সেনাবিদ্রোহে কাদর খাঁ নিহত হলে, আলিমোবারক লক্ষ্মণাবতীর শাসক হন। এই সময় সমগ্র সুলতানি সাম্রাজ্যে অরাজকতার সৃষ্টি হলে, মোবারক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যে ইলিয়স শাহ নামক তাঁর পালিত ভাই দিল্লী থেকে এসে মোবারককে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ ইলিয়াস শাহ বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব শুরু করেন। এই সময়ের পর থেকে বাংলাদেশ ক্রমে ক্রমে সুস্থির অবস্থায় আসতে থাকে। ফলে বাংলাতে পুনরায় সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দীর্ঘসময় বাংলায় কোনো কিছু রচিত হয় নি এমনটা বিশ্বাস হয় না। কিন্তু কোনো নমুনা না পাওয়ার কারণেই এমনটা ভাবতেই হয়।

মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০খ্রিষ্টাব্দ): রাজকীয় শক্তি হিসেবে মুসলমানদের বাংলাদেশে আসার আগে, বাংলাদেশে মূলত দুটি ধর্ম প্রচলিত ছিল। এর একটি বৌদ্ধধর্ম অপরটি সনাতন ধর্ম। সনাতন ধর্ম আবার নানা ভাগে বিভক্ত ছিল। যেমন শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব সৌর ইত্যদি। এছাড়াও ছিল বর্ণমূলক প্রভেদ। এর প্রধান চারটি রূপ ছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। সাধারণ মানুষের সাধারণ কথোপকথনে একটি কথ্য ভাষারীতি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ধর্মাচরণের জন্য বৌদ্ধদের ভিতর পালি এবং সনাতন ধর্মালম্বীদের ভিতর প্রচলন ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রচল ছিল।

এই ধারায় বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। বড়ু চণ্ডীদাস তৎকালীন অন্যান্য কবি বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাসের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। তবে চণ্ডীদাস যে কতজন ছিলেন এ নিয়ে নানা মত রয়েছে। যতজনই থাক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এ আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দের নমুনা পাওয়া যায় না। তাই ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশে মুসলমানদের আধিপত্য বিস্তারের আগেই এই কাব্য রচিত হয়েছিল। আবার এর ভাষা চর্যাগীতির ভাষার চেয়ে পরবর্তী ধাপের এটাও অনুমান করা যায়। তাই বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগ থেকে মধ্যযুগের শুরুর যে কোনো সময় এই কাব্যটি রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা যায়। পরবর্তী সময় মধ্যযুগীয় আরও কিছু কবি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। এঁরা ছিলেন চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস প্রমুখ।


বাংলাদেশে মুসলমানদের শাসনমালে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বিশাল অংশ মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। একই সাথে বৌদ্ধদের প্রভাব কমে গিয়েছিল আশঙ্কাজনকভাবে। মুসলমানরা সুলাতনরা বৌদ্ধ এবং মুসলমান ছাড়া বাকি জনগোষ্ঠীর নাম দিয়েছিল হিন্দু। এই হিন্দু শব্দটি তারা আমদানি করেছিল পারশ্য থেকে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে তা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল আগেই। বাংলাদেশে এই শব্দটি সনাতনধর্মীরাও গ্রহণ করে নিয়েছিল। এই সময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভিতর পৌরাণিক দেবদেবীর সাথে মিশে গিয়েছিল বাংলার লোকজ দেবদেবী এবং এদের উপখ্যান। চণ্ডী, বাসুলি, বিষয়রি বা মনসার মতো লৌকিক দেবদেবীরা বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছিল। মধ্যযুগে ধর্মানতরিত মুসলমানরাও এই সকল লৌকিক দেবদেবীর অনুরক্ত ছিল। আফগান শাসনামলের শেষের দিকে হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের সূত্রে সত্যপীরের পূজা চালু হয়েছিল। ১৪৮৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্ম হয়। তাঁর প্রচারিত বৈষ্ণব মত প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের উজ্জীবিত করেছিল। অনেকে সনাতন ধর্মী চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব মতকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেন নি। হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিভাজন এবং মুসলমাদের প্রভাব মিলিত হয়ে একটি মিশ্র ধারা বাংলা সঞ্চলিত হয়েছিল। এই সকল বৈষ্ণব ভক্তরা তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য রচনা করেছিলেন বৈষ্ণব পদাবলী। মুসলমান সাধক কবিরা তাঁদের মতকে প্রকাশ করার জন্য রচনা করেছিলেন ধর্ম সাহিত্য। হিন্দু ভক্ত কবিরা রচনা করেছিলেন মঙ্গলকাব্য। কিন্তু আদৃত হয়েছিল উভয় সম্প্রদায়ের মানুষকে।

মঙ্গল কাব্য

হিন্দুধর্মের ভক্ত কবিরা দেবতার আরাধনা, মাহাত্য-কীর্তন নির্ভর কাব্য। যা শ্রবণেও মঙ্গল হয়, এমন কি, যে কাব্য যার ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়, এমন বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল এই কাব্য।  মঙ্গলকাব্য ৫টি অংশে বিভাজিত ছিল। এর প্রথম অংশে ছিল দেব-দেবীর বন্দনা এবং দেবেদবীর উদ্দেশ্য কাব্যের উৎসর্গ বাণী। দ্বিতীয় অংশে ছিল কোনো কবি কর্তৃক কোনো আখ্যানের বর্ণনা। এই অংশে কবি নিজের পরিচয় তুলে ধরেন এবং যে দৈব দর্শনে তিনি কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন তার বর্ণনা। তৃতীয় অংশ দেবখণ্ড। এতে এক ঈশ্বরের সাথে স্থানীয় দেবীর সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ বর্ণনা করে। এই অংশের একটি পরিচিত অংশ হিসেবে প্রভু শিব সর্বদা একবার দর্শন দেন এই অংশে। চতুর্থ অংশে প্রধান বর্ণনা থাকে, সাধারণত এখানে দেবী অভিশপ্ত হয়ে স্বর্গ থেকে পতিত হন এবং স্বর্গীয় ধর্ম বিচ্যুত হন। তিনি তখন পুণর্জাগরণে নিমজ্জিত হন এবং মরণশীল হিসেবে পৃথিবীতে জীবনযাপন করেন। চূড়ান্তভাবে তিনি নিজেকে অর্চনীয় এক দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই গল্পের আরেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল তার কষ্ট ও কষ্টমোচন, এবং তার চরিত্র ও ব্যবহারের বর্ণনা দেয়া হয়। অধিকাংশ মঙ্গল কাব্য সাধারণ পয়ার ছন্দে রচিত।

 

মঙ্গলকাব্য (ধর্মমঙ্গল)

মঙ্গলকাব্যের একটি ধারায় শুধু হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক আখ্যানের সাথে ধর্মীয় আদর্শ প্রাচারের উদ্দেশ্যে রচিত হতো। এই জাতীয় মঙ্গলকাব্যকে ধর্মমঙ্গল নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই ধারার কবিরা ছিলেন‒ আদি রূপরাম, কানাহরি দত্ত,  খেলারাম, ঘনরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ বংশী দাস, দ্বিজ প্রভারাম, দ্বিজ মাধব, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, ময়ূর ভট্ট, মানিকরাম গাঙ্গুলি,  রূপরাম, শ্যামপণ্ডিত,  শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, সীতারাম দাস। এঁদের ভিতর সর্বপ্রাচীন কবি ছিলেন ময়ুর ভট্ট। ধারণা করা হয় তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিদ্যামান ছিলেন।

মঙ্গলকাব্য (চণ্ডীমঙ্গল)

মঙ্গলকাব্যের এই ধারায় রচিত হয়েছে কালকেতু ও ধনপতি উপাখ্যান। চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি ছিলেন চতুর্দশ শতকের মাণিক দত্ত। এই ধারার অন্যান্য কবিরা ছিলেন মাধবাচার্য, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, মুক্তারাম সেন, দ্বিজ হরিরাম, ভাবানী শঙ্কর, জগদীশ প্রমুখ।

মঙ্গলকাব্য (বিদ্যাসুন্দর উপখ্যান)

মঙ্গলকাব্যের এই ধারার কাহিনী সংস্কৃত কাব্য থেকে গৃহীত হয়েছিল। বিহলণ প্রণীত সংস্কৃত ভাষার কাব্য 'চৌর্যপঞ্চাশিকা'-য় এই আখ্যান রয়েছে। দীনেশচন্দ্রের মতে এইকাব্যের আদি রচয়িতা কবিকঙ্ক ছিলেন ময়মনসিংহ অঞ্চলের। অন্যদিকে দেখা যায় বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহের আদেশে দ্বিজ শ্রীধর বিদ্যাসুন্দর রচনা করেছিলেন ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। এই বিচারে দ্বিজ শ্রীধরকে বিদ্যাসুন্দরের আদি কবি বলা যায়। এরপর অন্যান্য যাঁরা এই কাব্য রচনা করেছিলেন, তাঁরা হলেন- গোবিন্দদাস, কৃষ্ণরাম দাস, কবিশেখর বলরাম,  চক্রবর্তী,  ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর, রামপ্রসাদ সেন, প্রাণরাম চক্রবর্তী, নিধিরাম আচার্য কবিরত্ন, কবীন্দ্র মধুসূদন, ক্ষেমানন্দ, বিশ্বেশ্বর দাস প্রমুখ।

এঁদের ভিতর কবিকঙ্ক জনৈক মুসলমান পীরের আদেশে এই কাব্য রচনা করেছিলেন। ধারণা করা হয় কবিকঙ্ক সত্যপীরে বন্দনা করেছিলেন উক্ত পীরের স্থানে। মুসলমান কবিদের মধ্যে সাবিরিদ খান একটি বিদ্যাসুন্দর রচনা করেছিলেন।

মঙ্গলকাব্য (মনসা মঙ্গল)

মঙ্গলকাব্যের এই ধারায় প্রায় শতাধিক কবি কাব্য রচনা করেন। বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনী অবলম্বনে এই কাব্যের সূচনা ঘটেছিল কবি কানা হরিদত্ত। এরপর মনসা মঙ্গল রচনা করেন বিপ্রদাস,  নারায়ণ দেব, দ্বিজ বংশীদাস, ষষ্ঠীবর, ক্ষেমানন্দ সেন, কেতকা দাস, গঙ্গাদাস, সেন,  ষষ্ঠীবর দত্ত, রামজীবন বিদ্যাভূষণ, জানকীনাথ, বৈদ্যনাথ জগন্নাথ, রাজা রাজসিংহ, গোপালচন্দ্র মজুমদার।


মনসামঙ্গলের বাইরে মুসলমান কবিরা রচনা করেছিলেন সত্যপীরের আখ্যান। তবে এই আখ্যান রচনায় বেশ কিছু হিন্দু কবির নাম পাওয়া যায়। এই ধারার উল্লেখযোগ্ কবিরা ছিলেন- শেখ ফয়জুল্লাহ, গরীবুল্লাহ শাহ, আরিফ, রাজেশ্বের ভট্টাচার্য, ফকীর রাম, দাস, অযোধ্যারাম দাস, কবিচন্দ্র প্রমুখ। মুসলমান কবিরা ধর্মীয় বোধে কিছু সত্যাসত্য নির্ভর কাব্য রচনা করেছিলেন। এর ভিতরে ছিল, আমীর হামজা, হানিফার লাড়াই, আবু শামা ইত্যাদি।

এই সকল কাব্যের কাহিনীগত বিষয় যাই থাক, বাংলা ভাষার ক্রবিবর্তনের ধারায় একটি নবতর বিষয় যুক্ত হয়েছিল। মুসলমানদের বাংলায় আসার আগে, বাংলা ভাষায় ছিল তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, অস্ট্রিক (মুণ্ডারি, সাঁওতালি), দ্রাবিড় শব্দ। মুসলমনাদের সূত্রে বাংলা ভাষায় আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার প্রচুর শব্দ প্রবেশ করেছিল। কালক্রমে এই শব্দগুলো বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নামাজ, রোজা, জাকত-এর মতো শব্দ ছাড়াও কলম, আদালত, আইন ইত্যাদি বৈষয়িক শব্দও বাংলাতে প্রবেশ করেছিল। এর প্রভাব দেখা যায় এই সময়ের কাব্যগুলোতে।

ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত, পরতুগিজ এবং বার্মিজ শব্দ দু একটি প্রবেশ করেছে। ফরাসীদের সাথে বাণিজ্যের সূত্রে কিছু ফরাসি শব্দও বাংলাতে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু ইউরোপের ভাষাগুলোর ভিতরে ইংরেজি শব্দ সব চেয়ে বেশি প্রবেশ করেছে। এবং এখনও তা অব্যাহত আছে। অন্যান্য জাপানি, চীনা, জার্মানি, রুশ ইত্যাদি শব্দও ঢুকেছে ইংরেজদের সূত্রেই।

আধুনিক যুগ (১৮০০খ্রিষ্টাব্দ-বর্তমান সময়)।

বাংলা শব্দবাংলালিপি

সূত্রভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। রূপা। বৈশাখ ১৩৯৬। ভাষার ইতিবৃ্ত্ত। সুকুমার সেন। আনন্দ পাবলিশারস্ প্রাইভেট লিমিটেড। নভেম্বর ১৯৯৪। বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। জুলাই ১৯৯৮ বাংলা সাহিত্যের কথা। ডঃ মুহম্মদ শহীদউল্লাহ। মাওলা ব্রাদার্স। সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা। ডঃ রামেশ্বর

No comments:

Popular Posts