আমি যখন ক্লাস এইটের সমাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে বসেছিলাম। প্রশ্ন পেয়েই আমার মাথা একদম ফাঁকা হয়ে গেল। "সমাজ কি? সংজ্ঞা সহ উদাহরণ দাও।" মার্কস ১০!
আগেরদিন রাতে একটানা একঘেয়ে সুরে আমি "সমাজের" সংজ্ঞা মুখস্ত করেছিলাম। তখন কিছুতেই মনে পড়ছে না। স্মৃতি শক্তি আমাকে এইভাবে ধোঁকা দিবে আমি ভাবতেও পারচিনা! মা বলেন দুধ খেলে স্মৃতি শক্তি বাড়ে। আমি বিস্বাদ দুধ মুখেই তুলতে পারিনা। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর কোনদিন গ্লাসের দুধ কাজের ছেলেটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে খাইয়ে দিবো না।
আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে সিদ্ধান্ত নেই বানিয়ে বানিয়েই লিখবো। বানিয়ে লেখার জন্য আমি নতুনভাবে চিন্তা করতে লাগলাম।
বাবা মা প্রায়ই বলেন, আমাদের সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের সব সময়েই গর্ব করা উচিৎ।তখন আমি মনে করার চেষ্টা করছি, তাঁরা "সমাজ" "সংস্কৃতি" বলতে ঠিক কী বুঝাতে ছেয়েছেন।
তখন আমার কয়েকটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।
"বুরহান" আঙ্কেলের বাসায় এক ডিনারের দাওয়াতে একজন আন্টির সাথে বাবার পরিচয় দিয়ে পরিচিত হয়েছিলাম। বাবারই এক বন্ধুর (জলিল আঙ্কেল) ঘনিষ্ট বান্ধবী তিনি। আন্টিটি গুণবতী এ নিয়ে কোনই সন্দেহ নেই। যেমন দেখতে রূপসী, তেমনি তাঁর আচার ব্যবহার। তাঁর সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলেই বুঝা গেল তিনি ভীষণ স্মার্ট! এই ধরনের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করতে যে কেউ পছন্দ করবে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, বড় হয়ে আমি এই আন্টির মতই কাউকে বিয়ে করব।
পরে অন্য এক পার্টিতে বুরহান কাকু জলিল আঙ্কেলের সাথে সেই আন্টিকে নিয়ে কথা বলতে গেলেন, "জানিস? সেদিন আমার সাথে নিশার (কাল্পনিক নাম) পরিচয় হয়েছিল।"
"হ্যা দেখেছি। খুব ঢলে ঢলে কথা বলছিল। তুই কী জানিস এই মেয়ে ডিভোর্সী?"
এই এক ঘটনা থেকেই আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন জেগে উঠলো।
ডিভোর্স নিয়ে কী আন্টি বিরাট কোন অপরাধ করে ফেলেছে? ভারতের সংবিধানেতো ডিভোর্স নেয়া কোন অপরাধ নয়। ইসলামী শরিয়া আইনেও নয়। আমাদের নবীজিরই (সঃ) যেখানে প্রায় সব স্ত্রীই ছিলেন ডিভোর্সী অথবা বিধবা। তাহলে কেন এটাকে এত বড় করে দেখা হয়? তবে এটাই কী আমাদের সংস্কৃতি?
তখন আমি ভাবলাম হয়ত কেউ একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল, তার সাথে মতের মিল হয়নি বলেই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আর জলিল আঙ্কেল যদি ডিভোর্সী হবার "অপরাধে" কাউকে দোষী জ্ঞান করেই থাকেন এবং অন্যের সামনেও তাঁর বদনাম করে থাকেন, তবে তিনি নিজেই বা কেন তাঁর সাথে এত ঘনিষ্টভাবে মেশেন? তাঁর সাথে আঙ্কেলের কথাবার্তা শুনলেতো বেচারী বুঝতেও পারবে না তিনি তাঁর পিঠে ছুরি চালান! এই হিপোক্রেসীও কী আমাদের সমাজের অংশ? এই নিয়েও আমাদের গর্ব করা উচিৎ?
যখন রোকেয়া আন্টি জানতে পারলেন যে নিশা আন্টির ডিভোর্স হয়েছে, তখন তিনি খুব দুঃখী গলায় জানতে চান, "তোমার খবর শুনলাম। খবরটা শোনার পর আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনাই। এতই খারাপ লেগেছিল, জানো! আচ্ছা, ঘটনা কী হয়েছিল বলতো! আমাকে বলতে পারো, আমি কাউকে বলবো না।"
এবং নিশা আন্টিও বোকার মতন সব কথা বলে দেন।
পুরো "সমাজে" রটে যেতে এক দিনও সময় লাগেনি। এবং বলাই বাহুল্য, বাড়তি মশলা যোগ।
"আমি আগেই বলেছিলাম, এই মেয়ে সংসারী মেয়ে না। আপনিইতো বিশ্বাস করেননি। এত ফাস্ট মেয়েরে বাবা! ফেবুতে ছবি দেখেন নাই? যে সমস্ত ড্রেস পড়ে,আর টাউনে গিয়ে একা একা গুরে। কত ছেলের সাথে ছেল্ফি তুলে ফেবুতে আপলোড করে। কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে এমন ড্রেস পড়তে পারে? আপনিই বলেন? ছিঃ!"
আমার মনে প্রশ্ন জাগে, এইটাও কী আমাদের সমাজ যা নিয়ে আমাদের গর্ব করা উচিৎ? যদি না হয়ে থাকে, তবে আমাদের সমাজের নব্বই ভাগেরও বেশি মানুষের এই স্বভাব আছে কেন?
একদিন ছোট কাকুও ফোন করেছিলেন নিশা আন্টিকে। আমি ক্রিকেট ব্যাট খুঁজতে কাকুর ঘরে গিয়েছিল, কাকু বুঝতে পারেননি। কাকুর কানে সমস্যাতো, ফোনের লাউড স্পিকার দিয়ে কথা বলেন অনেক জোরে কথা শোনা যায়। কাকু নিশা আন্টিকে বলচেন।
"তোমার খবরটা জানার পর আমার খুব খারাপ লেগেছে বুঝলে? আমি তোমার পক্ষেই আছি। যদি কখনও কিছুর প্রয়োজন হয়, তবে আমি মাত্র একটা ফোন কল দূরে।"
"থ্যাংক ইউ ভাইয়া।"
"না না, থ্যাংকস দিতে হবে না। আর ইয়ে, মানে ভাইয়া বলো না। আমাকে তোমার বন্ধু মনে করো।....."
এইটা এমনিতেই মনে পড়লো। বিশ্বের সব সমাজের সব পুরুষেরাই এমন। এইটি পুরুষ সমাজের সংস্কৃতি, যা নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই।
সমাজের সংজ্ঞা কিছুতেই মনে না পড়ায় আমি আরেকটা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করলাম।
আমাদের পাশের বাসার নিম্মি আপুকে তার স্বামী পিটিয়ে আই.সি.ইউ তে পাঠিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ কেস নিতে এসেছিল, কিন্তু নিম্মি আপুর মা বাবা কেস ফাইল করতে রাজি হয়নি। মেয়ে "যদি" বেঁচে ফিরে আসে, তবে তাঁকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার স্বামীর বাড়ি ফেরত পাঠানো হবে। মেয়ের সংসার ভেঙ্গে গেলে সমাজে মুখ দেখাবেন কী করে?
আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। আমি সমাজের সংজ্ঞা খুঁজে পেতে শুরু করেছি। তবে তার আগে মনে কিছু প্রশ্ন জেগেছে।
যেই সমাজের কারনে কারও মেয়েকে সারাজীবন জানোয়ারের হাতে মার খেয়ে থাকতে হয়, কোথাও কোথাও ক্ষেত্র বিশেষে মেয়েকে আত্মহত্যাও করতে হয়, সেই সমাজকে নিয়ে গর্ব করার কথা আমাদের শেখানো হয়?
নিম্মি আপুর আব্বা মারা গেলে তাঁর জন্য দুই ফোঁটা "আন্তরিক" অশ্রুজল কে ফেলবে? সমাজ, না নিম্মি আপু? কারও বাবা বিপদে পড়লে কে নিঃস্বার্থভাবে তাঁর পাশে থাকবে? সমাজ, না তাঁর মেয়ে? তাহলে বাবা মারা কেন নিজেদের মেয়েকে ফেলে সমাজকে সুখী করতে ব্যস্ত? এইটাই আমাদের সমাজ? একে নিয়েই গর্ব করতে হবে?
আমার উদাহরণ পেয়ে গেছি। এবার আমি সংজ্ঞা লিখতে শুরু করলাম।
"সমাজ" হচ্ছে সেই মানবগোষ্ঠী যারা কারও মেয়ের বিয়ের দাওয়াত পেয়ে নিজের জ্ঞাতি গুষ্ঠীসহ খেতে চলে আসে, এক টাকা দিয়ে সাহায্য না করলেও আয়োজনে একটু এদিক ওদিক হলে বদনাম করতে এতটুকু ছাড় দেয় না; কনের বিয়ের সাজে একটু এদিক ওদিক হলে আড়ালে গিয়ে বলে, "বাজে মেকাপ! একদম ভাল দেখাচ্ছে না" - এবং সেই বধূ যদি ভবিষ্যতে স্বামীর হাতে মার খায়, তবে এরাই উল্টো মেয়েকে বুঝাতে আসে, "সহ্য করে নাও মা। সংসারে টুকি টাকি এমন হয়েই থাকে।"
লেখা শেষে স্যার! আমার উত্তর কী সঠিক হয়েছে? আমাকে দশের মধ্যে কত দিবেন?
No comments:
Post a Comment