জাকারিয়া ইছলাম
দরজা খুলে বাসায় ঢুকতেই প্রচন্ড শব্দে কেশে উঠলাম। পুরো ফ্ল্যাট ধোয়ায় অন্ধকার, পোড়া গন্ধে মনে হচ্ছে নাক মুখ উলটে আসবে। চোখ জ্বলছে, আমি এর ভেতরই কোন রকমে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বসার রুমে ব্যাগটা রেখে ডাকলাম "ফারিয়া? কোথায় তুমি? কি পুড়ছে?"
.
কিচেন থেকে ঠিক তখুনি ফুঁপানির আওয়াজ আসে। ধোঁয়া সেখানে থেকেই আসছে। আমার বুক ধ্বক করে উঠে।
.
কিচেন অন্ধকার। তার ভেতর আবছা ছায়ার মত মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আঁচল কোমরে গোঁজা, চুল খোপা করা। ছোট্ট ফর্সা মুখটা লাল হয়ে আছে, ঘাম-চোখের পানিতে মাখামাখি হয়ে আছে। মনে হচ্ছে এখুনি হাউমাউ করে কান্নায় ভেংগে পড়বে। আমি ছুটে খুব কাছে গিয়ে দুহাতে তার গাল ধরে, তার হাত দুটো উলটে পালটে দেখে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম "কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছো? আগুন কিসে লাগসে?"
.
ফারিয়া কিচ্ছু না বলে আমার বুকে মুখ গুঁজে চাপা গলায় ফোঁপাতে লাগলো। আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে বললাম "এই বোকা মেয়ে! কি হইসে বলবা?"
.
"আমি... আমি..." মেয়েটা কান্নার দমকে কথাই বলতে পারছে না। আমি তাকে বুকে নিয়েই রান্না ঘর থেকে বের করে বেড রুমে নিয়ে এলাম। জানালা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিলাম। ধোঁয়ার ঝাঁজ কিছুটা কমবে। তারপর তাকে আবার বুকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম "কি হইসিলো?"
.
মেয়েটা সহজে কাঁদে না। কিন্তু একবার চোখ থেকে পানি বের হতে শুরু করলে থামানো মুশকিল। এর ভেতরই সে আধো আধো ভাংগা গলায় ছোট্ট বাবুর মত বলতে লাগলো "আমি তো তোমার জন্য ইত্তু গরুর মাংস রান্না কত্তে চাইসিলাম... মশলা দিয়ে কষিয়ে সিদ্ধ হবার জন্য পানি দিয়ে জাল বাড়িয়ে বই পত্তে পত্তে কিভাবে যেন ঘুমিয়ে গেছি... এইদিকে মাংসের পানি শুকিয়ে মাংস গুলো... আমি একটা অলক্ষি..." বলে আবার কান্না শুরু করলো!
.
আমি তার কানে ফিসফিস করে বললাম "কিচ্ছু হয় নাই... ইকটুও কানবা না" বলে রান্না ঘর থেকে ঘুরে এলাম। পুরে কালো হয়ে যাওয়া পাতিলের উপর কুচকুচে কালো মাংস। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম- ভাগ্য ভালো যাস্ট মাংসের উপর দিয়ে গেছে। ঘুম না ভাংলে যদি ঘরেই আগুন ধরে যেত?
.
রুমে ফিরে দেখি সে গুটিসুটি মেরে বসে আছে মাথা নিচু করে। চোখ মুখ ফোলা ফোলা। এত্ত মায়া লাগলো। কানের কাছে মুখ টা নামিয়ে ফিসফিস করে বললাম "এই, হাতমুখ ধুয়ে রেডি হও"
সে চমকে মুখ তুলে বললো "মানে?"
"চলো বাইরে খেয়ে আসি"
"তুমি যাও। আমি খাবো না কিচ্ছু" বলে সে অন্যদিকে ফিরে চেয়ে গাল ভেজাতে লাগলো।
" আমি এই দুপুর বেলা যাবো একাএকা খেতে?"
সে কিচ্ছু না বলে ফোঁপাচ্ছেই।
আমি তার সামনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম "এই মেয়ে! আমার দিকে তাকাও। এত্ত আপসেট হবার কি আছে?" পুড়তেই পারে রান্না, এরচেয়ে তো খারাপ কিছু হয় নাই!"
.
ফারিয়া অনেক কষ্টে ভাংগা গলায় বললো "খারাপ হতে বাকি কি আছে? আমি রান্না বান্না কিচ্ছু পারি না। প্রতিদিনই কিছু কিছু হচ্ছে... আজ লবণ দেই না, কাল হলুদ দেই না। আজকে তো পুড়ায়ই ফেললাম। কত্ত কষ্ট করে অফিস থেকে আসছো, এখন আবার বাইরে যাওয়া লাগবে খেতে, আমার জন্য! তোমার আম্মু ঠিকই বলেছিলেন, তোমার উচিৎ ছিলো উনার পছন্দের মেয়েটাকে বিয়ে করা, এটলিস্ট তিনবেলা শান্তিতে খেতে তো পারতা!" বলে আবার দুইহাতে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করলো!
.
আমি হাহা করে হেসে দিয়ে তার হাত দুটো সরিয়ে তার ঠোঁট দুটো আলতো করে ঠোঁটে নিয়ে কান্না থামিয়ে দিলাম। বেচারি রান্না বেশ ভালো পারে, বিয়ের আগে তার হাতে রান্না খাবার জন্য কত কি যে পাগলামি করতাম, কত ছুতায় তার বাসায় যেতাম। বিয়ের পর নতুন বাসায় এসে নাকি নার্ভাসনেস থেকেই কিনা কে যানে, একটু ভুলটুল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তারপর যা কান্ডগুলো করে, এত্ত কিউট! আমি খাওয়ার সময় সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে সব ঠিকঠাক আছে কিনা।ফিসফিস করে তার কানে কানে বললাম "তিনবেলা রান্না তো একটা কাজের বুয়াও ভালো করে করতে পারে... তোমার মত প্রতিবেলা উলটাপালটা করে সেটা নিয়ে এরকম হাপুস নয়নে কিউট করে কান্নাকাটি করার বাবুন কই পেতাম?"
.
সে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে নাকে-গালে তার ভেজা গাল ঘষতে ঘষতে বললো "আমি সরি বাবুন... আর কক্ষনো এরকম হবে না..." আমিও ফিসফিস করে বললাম "হোক, বারবার হোক... তাতে তোমার এই আদরটুকু তো পাই" বলে আবার চুমু খেলাম।
.
আচ্ছা কাঁদলে মেয়েটাকে এত্ত অসহ্য কিউট লাগে ক্যান?
No comments:
Post a Comment