ভাষা বদলি করুন

The Only way to stop any pain in your life is to accept the fact that nothing is yours, nothing was yours, and nothing will ever be yours. They are worldly attachments; given by Allah, belonging to Allah and returning beck to Allah.

September 17, 2016

লেবু গাছ

স্যার বললেন, ‘গাছতো শ্যাষ। যা দু চার খানা আছে, তাও মরা- আধ মরা’।

আমি ঘাড়ের রগ ত্যাড়া করে বললাম,-‘কিন্তু আমিতো ৫ টাকাই দিছি। সবাই যদি ৫ টাকায় ৩ টা গাছ পায়, আমি কেন পাবো না?’।

-‘তুই পাবি না তাতো বলা হয় নাই। পাবি, কিন্তু মোটা তাজা ভালো গাছগুলা আগে যারা আসছিলো, তারা নিয়া গেছে। এখন এইগুলা আছে, নিলে এই-ই নিতে হবে’।

আমি করুণ চোখে তাকিয়ে আছি। স্কুলের বারান্দায় ক’খানা আম আর কাঁঠাল গাছের চারা পড়ে আছে। এগুলো মোটামুটি চলে। কিন্তু আমার আগ্রহ লেবু গাছ নিয়ে। এখানে একটা মাত্র লেবু গাছের চারা আছে, কিন্তু তার মৃতপ্রায় অবস্থা। একখানা ডাল ভাঙ্গা। পাতাগুলোও শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। বাঁচবে না নিশ্চিত। কিংবা এখনই মরে গেছে।

আমার কপাল বরাবরই এমন। অলওয়েজ দ্যা লাস্ট ম্যান। সবাই চেটেপুটে খেয়ে যাওয়ার পরে আমার ভাগ্যে থাকে কাঁটাঘুঁটো। আমি তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ি। গভর্নমেন্ট থেকে প্রতি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য গাছের চারা দেয়া হয়েছে। ৫ টাকায় ৩ টি চারা। সবাইকে নিতে হবে। সমস্যা হচ্ছে আমি দেরী করে এসেছি, আমার ভাগ্যে তাই এই মরা-আধমরা। আমি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বললেন, ‘এক কাজ কর, তুই ৩ টার বদলে ৪ টা চারা নিয়া যা। দুইটা আম, দুইটা কাঁঠাল’।

তিনি স্কুলের দপ্তরী জয়নালকে বললেন আমাকে চারটা গাছের চারা দিতে। জয়নাল এসে প্রথমে যেটা করলো, সেটা হলো, মরা কিংবা আধমরা লেবু গাছটা ছুড়ে ফেলে দিল মাঠের এককোনায়। সেখানে দঙ্গল হয়ে আছে আরও অনেক ভাঙ্গা এবং মরা গাছের চারা। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার লেবু গাছ-ই চাই। স্যার আর জয়নাল কে অবাক করে দিয়ে আমি সেই দঙ্গল থেকে মুমূর্ষু লেবু গাছটা তুলে নিলাম।

স্যারকে বললাম, ‘আমাকে আর একটা কাঁঠাল আর একটা আমগাছ দেন’।
স্যার অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। আমি এক হাতে লেবু গাছের মৃতপ্রায় চারা আর অন্যহাতে আম আর কাঁঠাল চারা নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। পেছনে জয়নালের কোঁচকানো কপাল, আর স্যারের বিস্মিত দৃষ্টি ঠিক টের পাচ্ছি।

লেবু গাছটা লাগালাম রান্নাঘরের পাশে।

বাকী দুখানা পুকুর পাড়ে। তারপর দিব্যি ভুলে গেলাম। আমার এসএসসি পরীক্ষা হলো, রেজাল্ট দিল, কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে থাকি। মাস-দু’মাসে দিন কয়েকের জন্য একবার বাড়ী যাওয়া হয়। গাছ লাগানোর প্রায় বছর চার-পাচ কেটে গেছে। পুকুর পাড়ে আম গাছটি দিব্যি লকলক করে বেড়ে উঠেছে। দেখলে মনেই হয় না, এটা আমি লাগিয়েছি! কাঁঠাল গাছটার কোন খবর নেই। কিন্তু চমকে দিয়েছে সেই মুমূর্ষু লেবুর চারা। রান্নাঘরের কোনায় সে দিব্যি গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। সবুজ কচকচে পাতায় বাড়ন্ত যৌবতী শরীর। সমস্যা হচ্ছে গায়ে গতরে এমন দস্যি মেয়ের মতন বেড়ে উঠলেও সে তার অত বড় ঝাঁকড়া গতরে একখানা লেবুও ধরতে পারে নি। এই নিয়ে আম্মার বিস্তর গালমন্দ। চোখের সামনে লেবু গাছ দেখলেই আপন মনে বকবক, ‘এত বড় হইয়া হইয়া কি লাভ, লেমু গাছ দিয়া কি আর তক্তা হয়? হেই তক্তা দিয়া কি পালঙ্ক হইব? এতো বড় গাছ রাইখা কি লাভ’?

ঐ পর্যন্তই। আম্মা কিন্তু লেবু গাছ কাটেন না। লেবু গাছ আরও দীপ্তি নিয়ে, জায়গা নিয়ে দিনে দিনে বেড়ে ওঠে। তার ছায়ায় ঢেকে যায় অর্ধেক উঠান। সেবার বর্ষায় ফসল শুকানোর সুবিধার্থে রান্না ঘরটা সরাতে হলো। কারণ, এতে উঠান খানিকটা বড় হবে। ফসল রাখতে এবং শুকাতে তখন পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যাবে। সমস্যা হচ্ছে লেবু গাছ। রান্নাঘর সরাতে উঠান যখন বড় হলো, লেবু গাছটা তখন যেন পরে গেলো উঠানের মাঝখানে। এবং তার ছায়ায় যেহেতু অর্ধেকটা উঠান ঢেকে থাকে, সেহেতু এবার তার চূড়ান্ত অপ্রয়োজনীয়তা প্রকট হয়ে উঠলো। আমার তখন সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। বাড়ীতে এসেছি সবাইকে বলে যেতে।

খেতে বসে আম্মা হঠাৎ বললেন, ‘লেমু গাছটাতো আর রাখা যাইতাছে না রে। দুই চাইরডা লেমু হইলেও না হয় কথা আছিল। তারওপর পুরা উঠান দখল কইরা আছে’।
আমার তখন পরীক্ষা নিয়ে বিস্তর টেনশন। আমি ভাত মুখে গমগম করে আম্মাকে বললাম, ‘কাইটটা ফালাও। লেমু না হইলে অত্তবড় গাছ রাইখ্যা কি লাভ?’

পরদিন ভোরে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরুবো। খুব ভোরে পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে উঠানের উপর দিয়ে ঘরে ফিরছে। সূর্যটা কেবল তেরছা ভাবে জেগে উঠছে। ভোরের সেই সোনালী আলোয় আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। লেবু গাছটার সারা শরীরে যেন ঝলমলে তারার মেলা বসেছে। কচি সবুজ পাতাগুলোয় সূর্যের সেই তেরছা আলো ঠিকরে পড়ছে। আমি সম্মোহিতের মতন তাকিয়ে রইলাম। এই সৌন্দর্য এই পৃথিবীর না, অন্য কোন পৃথিবীর। অন্য কোন গ্রহের। অপার্থিব।

ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আম্মাকে বললাম, ‘গাছটা থাকুক। কাইটেন না’।

আমি হোস্টেলের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরুলাম। আমি জানি, আম্মা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সেদিনের মতো। সেইদিনের জয়নাল দপ্তরী আর স্যারের মত। 
আম্মার চোখেও বিস্মিত দৃষ্টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি।
আব্বা খুব ছোট্ট একটা চাকুরি করেন। তার পক্ষে একা সংসার, আমার ছোট দুই ভাই-বোনের পড়াশোনা এবং আমার খরচ চালানো দুরূহ ব্যাপার। আমি তাই টিউশন করে চেষ্টা করি নিজের খরচ চালানোর। ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল দিচ্ছি। এই সময় বিনা মেঘে বজ্রপাত। আব্বা স্ট্রোক করলেন। তার ডানপাশটা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তাকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা করানোর মতোও অবস্থা আমাদের নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়ি নিয়ে আসা হলো। তার চাকুরী নেই। আমাদের তখন অতল সমুদ্রে অকুল পাথার অবস্থা। আমি নানাভাবে চেষ্টা করছি টাকা উপার্জনের। ক্লাস পরীক্ষার খেয়াল নেই। তারপরও নিজের খরচ জুগিয়ে বাড়তি যে টাকাগুলো বাড়িতে পাঠাই তাতে তেমন কিছুই হয় না। আম্মাও নানাভাবে চেষ্টা করে চলেন।

শুরু হয় টিকে থাকার এক অদ্ভুত লড়াই।

সেবার বর্ষায় বাড়িতে গেছি। খুব ভোরে গাড়ী থেকে নেমে বাড়ির উঠোনে পা রাখলাম। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই তেড়ছা সূর্যের সোনালী আলো। সেই আলোয় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম, বিশাল শরীরের লেবুগাছটার শরীর জুড়ে থিকথিক করছে অসংখ্য লেবু। আমাদের গ্রামের ভাষায় বলে ‘কাগজি লেবু’।

লেবুর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জাত। সেই লেবুতে ছেয়ে আছে গাছের প্রতিটি অংশ। কি অপার্থিব এক গন্ধে ম’ ম’ করছে ভোরের শীতল বাতাস। আম্মা নামাজের সাদা শাড়ী পরা, তিনি আমার হাতের ব্যাগটা নিতে নিতে বললেন, ‘আল্লাহর কি কেরামতি, দেখছ বাজান? যেই লেমু গাছে এতো বছর একটা দানা পর্যন্ত হয় নাই, সেই গাছে কয়দিন আগে থেইকা কি কুদরতি ফল ফলছে। বেইচ্যাও কুলাইতে পারি না। পাশের বাড়ির হাচানরে দিয়া বাজারে পাঠাই, সে প্রতি বাজারে চাইর-পাঁচশ টাকার লেমু বেইচ্যা দেয়’।

আম্মার কথা আমার কানে ঢোকে না। আমার হতভম্ব ভাব কাটে না। আমি সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকি।

আমাদের সেই ভয়ঙ্কর দুর্দিনে সেই মুমূর্ষু লেবুর চারাটি দু হাত বাড়িয়ে বুক পেতে দেয়। অস্বাভাবিকভাবে প্রতি মৌসুমে দুইবার করে ফল দিতে থাকে সে। বাজারে তখন লেবুর চাহিদা অস্বাভাবিক রকম বেশি। দামও। আম্মা পাশের বাড়ির পিচ্চি ছেলে পুলেদের দিয়ে লেবু তুলে বাজারে পাঠান। এক বিস্ময়কর বিকল্পে আমরা আমাদের টিকে থাকার যুদ্ধে জয়ী হবার স্বপ্ন দেখি। সেখানে ক্রমশই বিস্তৃত হতে থাকে এক মুমূর্ষু লেবু চারার বিশাল ছায়া। সেই ছায়া আমাদের ঢেকে রাখে। আমার খানিক নিশ্চিন্ত বোধ করি। আরেকটা দিন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। লেবু গাছটা তার ছায়া আরও গভীর করে, বিস্তৃত করে। তার শরীর জুড়ে ফুটতে থাকে থোকায় থোকায় ম’ ম’ গন্ধের লেবু!

ডিগ্রী শেষেই আমি মোটামুটি ভালো একটা পার্ট টাইম চাকুরি পেয়ে যাই। সেই ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত অবস্থা কাটতে শুরু করে। জীবন ক্রমশই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আম্মার ফোন পেয়ে এক কুয়াশার ভোরে আমি বাড়ি যাই। ভোরের সূর্যটা কুয়াশার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে। সেই অদ্ভুত আবছা আলোয় আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকি উঠোনের লেবু গাছটির দিকে। সেই সবুজ সতেজ ঝলমলে গাছটির প্রতিটা পাতা যেন আগুনে ঝলসে গেছে। গাছের গা জুড়ে অজস্র পোকা। মরা আর পোকায় খাওয়া পাতাগুলো ডালে ডালে ঝুলছে। বীভৎস এক দৃশ্য। যেন বাস্তব কঙ্কাল।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকি লেবু গাছের দিকে আমার দু চুক্ষঁ দিয়ে ঝর-ঝর পানি পড়তে তাকে। আমার হাতের ব্যাগভর্তি বোনের নতুন জামা, মায়ের শাড়ী, ভাইয়ের শার্ট দেখি। আমার পকেটে চাকুরীর প্রথম মাসের বেতনের টাকা। লেবু গাছটা না হলেও আমরা এখন দিব্যি চলতে পারবো! তার পরেও মনে খুব কষ্ট হচ্ছে লেবু গাছটা দেখে। আমার হঠাৎ মনে হতে থাকে, এটি কোন গাছ ছিল না। এটি অন্য কিছু ছিল। অন্য কিছু। ব্যাখ্যার অতীত কিছু। যিনি এই বিশ্বব্রহ্মমাণ্ড পরিচালনা করছেন তার নিখুঁত পাণ্ডুলিপির এক অদ্ভুত চরীত্র ছিল সেই মুমূর্ষু ছোট্ট লেবুর চারাটি। নিজের দায়িত্ব পালন শেষে সে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করেছে। সে তার দায়িত্ব পালন করতে এসেছিল। দায়িত্ব পালন শেষে সে ফিরে গেছে!

আমি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে লেবু গাছটির সেই কঙ্কাল শরীরের দিকে তাকাই। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে থাকে। কুয়াশায় ঢাকা সেই ভোরের আকাশেও আমি কিছু খুঁজে পাই না। কেবল কি যেন এক রহস্যে ঢেকে আছে চারপাশ। এই রহস্যের কোন শেষ নেই। এই রহস্যের কোন শুরু নেই। এই রহস্য অনন্ত, সীমহীন।

আমার হঠাৎ মনে হয়, থাকুক কিছু রহস্য। থাকুক কিছু আবছায়া। রহস্যের অপর নামই সমর্পণ। আমরা রহস্যেই সমর্পিত হই। আমি আলতো হাতে লেবু গাছটার শরীর ছুঁয়ে দেই। যেন কিছু একটা টের পাই। যেন কিছু একটা ঘটে যায় আমার শরীর জুড়ে। অদ্ভুত কিছু। তীব্র কিছু। তীব্র কিছু একটা টের পাই। আমার শরীর জুড়ে।

আসলেই কি টের পাই? নাকি পাই না?নাকি বিভ্রম? শুধুই বিভ্রম? 
আমি ভাবতে তাকি ঈশ্বর এই পৃথিবীতে আমি, আমরা,গাছপালা,প্রনি  সবাই কে একটা ধাইত্য দিয়ে পাটিয়েছেন যেইদিন  আমাদের ধাইত্য শেষ, সেইদিন আমরাও শেষ।

No comments:

Popular Posts