জাকারিয়া ইছলাম
ছোটবেলায় আমার নানারকম স্বপ্ন ছিল। তারমধ্যে ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখা একটি। কিন্তু ওই গাঁয়ে তা অসম্ভব! আমার বাবা আমার মায়ের জন্য শাড়ি কিনতেন, সেই শাড়ির ভেতর পুরনো দিনের পত্রিকা থাকত। আমি সেই পত্রিকা জমিয়ে রাখতাম। একদিন সেই পত্রিকা বের করে পত্রিকার সংবাদ থেকে আমি আমার নামের অক্ষরগুলো, ‘জা, আকার, কা, আকার, 'র, ইকার 'য়, আকার কেটে পাশাপাশি সাজালাম। তারপর মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলাম, ‘জাকারিয়া ইছলাম’। আমার নাম ছাপার অক্ষরে!
আমার সেই পাগলামি দেখে চারপাশে সেকী হাসিঠাট্টা! কিন্তু তাতে কী, স্বপ্নতো পূরণ হয়েছিল! কারো স্বপ্নের পেছনে ছোটাটা কখনও কখনও আমাদের চোখে উদ্ভট হয়! আমরা হাসিঠাট্টা করি! কিন্তু আমরা কি জানি, স্বপ্ন সত্যি করবার চেষ্টাটা কি কঠিন? আর স্বপ্ন পূর্ণ করবার আনন্দটা কি অপার!
আমরা জানিনা। কারণ, আমরা বেশিরভাগই না পেরে অজুহাত দেখাই, ‘টাকা নেই, ক্ষমতাবান বাবা, চাচা, মামা, খালু নেই, আমি লম্বা নই, আমার চেহারা ভালোনা, আমি ফর্সা নই। আরও কতকত অজুহাত! কিন্তু আমরা জানিনা, কেউ কেউ এইসব অজুহাত না দিয়ে কেবল চেষ্টা করে, সাধ্যমত, চেষ্টা, চেষ্টা, চেষ্টা! কারণ সে জানে, নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টার আনন্দ কী অসীম।
একবার এক ছবিতে দেখেছিলাম, একলোক মহিষের পিঠে বসা। কিন্তু তার মহিষের মুখে হাতির শুঁড়ের মতন প্ল্যাস্টিকের লম্বা শুঁড়! কী বিদ্ঘুটে! আমরা কী হাসি ঠাট্টাটাই না করলাম! কিন্তু একবারও ভাবিনি, মানুষটা হয়তো তার বুকের ভেতর পুষে রেখেছিলো একটি হাতির স্বপ্ন! সেই হাতিতে সওয়ার হয়ে রাজার মতন ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন! কিন্তু সেই সাধ্য তার নেই! তাই সওয়ার হয়েছিলেন স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখবার চেষ্টায়!
আমরা যাকে উদ্ভট বলি!
প্রথম যেদিন বাহুতে পাখির পালক লাগিয়ে মানুষ উড়বার চেষ্টা করেছিল, সেদিনও কেউকেউ সেসব উদ্ভট বলে হেসেছিল! অথচ আকাশে উড়বার দুর্দমনীয় স্বপ্ন আর চেষ্টাটাকে কেউ দেখেনি! কে জানে, সেই চেষ্টার ভেতরই হয়তো লুকিয়ে ছিল আজকের জ্যোতির্বিদ্যা!
লেখার বাকিটুকু পড়ে কেউকেউ হয়তো আমাকে গালি দিবেন, ‘শালা আঁতেল, বেশি বুঝো’! তারপরও বলছি, ছোটবেলায় সিনেমা দেখতে গিয়ে নায়ক হবার ইচ্ছে হয়নি কার? একা একাই অমন কুড়ি পঁচিশজন গুণ্ডার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, অনিন্দ্য সুন্দরী নায়িকাকে নিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করেনি কার? আপনাদের করেছে কিনা, জানিনা। আমার করত! খুব করত! কিন্তু আমার অজুহাত ছিল, কে আমাকে নায়ক বানাবে! বাবা মা দেবেনা। চেহারা ভালোনা। কালো। চাপাভাঙ্গা, শুকনো! চাচামামা কেউ নেই। কিকরে হব!
আমার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু চেষ্টা ছিলনা।
অজুহাত ছিল, কিন্তু অজুহাত ডিঙ্গানোর সাহস ছিলনা।
কিন্তু কারোকারো থাকে।
ডিসলাইনের বিজনেস করতে গেলে অজস্র সিনেমা দেখতে হয়। সেই সিনেমা দেখে ‘আলম’ নামের কালো, টিনটিনে, শুকনো, হাড়জিরজিরে, চাপাভাঙ্গা মানুষটারও এক অসম্ভব স্বপ্ন জেগে উঠেছিল, ‘ইশ, যদি নায়ক হতে পারতাম!
কিন্তু তার সামনে অসংখ্য সীমাবদ্ধতার অজুহাত, ‘তার সৌন্দর্য, স্বাস্থ্য, রং, উচ্চতা কিছুই নেই, কিচ্ছুনা।‘
কেবল আছে স্বপ্ন। ষোলআনা স্বপ্ন।
নায়ক হবার এক অসম্ভব অবিশ্বাস্য স্বপ্ন!
মানুষটা কারো কোন ক্ষতি না করেই একদিন সেই অসম্ভব অবিশ্বাস্য স্বপ্নটা সত্যি করে ফেলল! লোকলজ্জার ভয়, দ্বিধা, সংকোচ সব পায়ে দলে সে তার স্বপ্নটা সত্যি করে ফেলল। সে সত্যিসত্যি নায়ক হয়ে গেল!
কী অসম্ভব চেষ্টায়, দুঃসাহসে সে পায়ে দলেছে তার সকল অজুহাত, সীমাবদ্ধতা, অক্ষমতাকে। ছুটে গেছে আরাধ্যতম স্বপ্নের পিছু। কারো কোন ক্ষতি না করেই! কিন্তু আমরা তা দেখিনি। আমরা দেখেছি হাস্যকর, উদ্ভট এক মানুষ কে!
কারণ ব্যক্তিগত জীবনে আমরা স্বপ্নবিহীন, অজুহাতপ্রবণ, পরচর্চাকারী, অথর্বসব মানুষ!
No comments:
Post a Comment