জাকারিয়া ইছলাম
০১.
কমিটমেন্ট, সম্পর্ক, ভালোবাসা, বিট্রেয়াল, ভালো, মন্দ।
খুব সহজেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া অনেকগুলো ব্যাপার। এই ব্যাপারগুলোয় একটা বিষয় খুব অদ্ভুত। সেই বিষয়টি হল, ‘ভুল বোঝাবুঝি বা পরস্পরকে বুঝতে না পারা’। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কে কাকে বুঝতে পারছে না? কিংবা ভুল বা সমস্যাটি কার?
ধরুন আপনি একটি ছেলে।
প্রবল বিষাদগ্রস্ত বা ভেঙে পড়া কোন এক মেয়ের সাথে আপনার পরিচয় হল ইউনিভার্সিটিতে, ফেসবুকে বা অন্য যেকোন উপায়ে, তার সাথে গল্প হল, খানিকটা আস্থার-শেয়ারিংয়ের সম্পর্কও তৈরি হল। একদিন মেয়েটি তার এই বিষণ্ণতার কারণটি আপনাকে বলল। সে বলল, একটি ছেলেকে সে ভালবাসত। অনুভূতির গভীরতম স্পর্শে সে ছেলেটিকে ভালবাসত। তাদের সম্পর্কটা চলছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ছেলেটি বদলে যেতে থাকল। সে মেয়েটির উপর একের পর এক অন্যায় আচরণ করতে থাকল। বিশ্বাসঘাতকতা করতে শুরু করল। কিন্তু মেয়েটি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেতে থাকে।
কারণ?
কারণ মেয়েটিই এই সম্পর্কে কেবল সত্যি সত্যি ভালবাসত। ছেলেটি নয়। মেয়েটি এই ভালোবাসার কারণেই কখনোই, কোনভাবেই ছেলেটিকে ছেড়ে চলে যেতে চায় নি। কোনভাবেই না! কিন্তু শেষ অবধি ছেলেটি এমন সব আচরণ, কাজ করতে থাকল যে মেয়েটির পক্ষে আর সহ্য করা সম্ভব হল না। আসলে কেবল সে বলেই ছেলেটির এমন ভয়াবহ আচরণ, দিনের পর দিন এমন অন্যায় অত্যাচার নীরবে মেনে নিয়েছিল। অন্য কেউ হলে কখনোই মেনে নিত না!
এই পর্যায়ে এসে মেয়েটি হয়তো হাউমাউ করে কাঁদবে। সেই কান্না আপনার বুকের ভেতর তোলপাড় অনুভূতি তৈরি করবে। আপনার অবচেতন মনে, মনে হতে থাকবে, ‘আহারে! কি অদ্ভুত, অসাধারণ সর্বংসহা সংবেদনশীল, সেক্রিফাইসিং কিন্তু দুর্ভাগা এক মেয়ে! অন্য আর দশটা মেয়ের চেয়ে কত আলাদ! অথচ ছেলেটা কী করে এমন করল...!’
মেয়েটার জন্য আপনার বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে উঠবে। আপনার মনে হতে থাকবে আপনি এই অসাধারণ সংবেদনশীল মেয়েটার পাশে দাঁড়াতে চান। শক্ত করে তার হাত ধরতে চান। কোন এক গভীর অনুভুতিময় রাতের নৈশব্দে আপনি হয়তো ফোনে মেয়েটাকে ফিসফিস করে বলবেন, ‘তোমার হাতখানা দাও, এই যে আমি শক্ত করে ধরলাম, আরও কক্ষনো এই হাত আমি ছাড়ব না (কমিটমেন্ট)। মেয়েটা আরও হাউমাউ করে কাঁদবে। আপনি হয়তো আরও প্রগাঢ় গলায়, ভেজা স্বরে ফিসফিস করে বলবেন, ‘তুমি আমার কাছে আসো, অনেক কাছে। বুকের ভেতর। তোমাকে আর কখনও কেউ কাঁদাতে পারবে না। কেউ না। আমি এমন করেই তোমায় বুকের ভেতর আগলে রাখব। সারাজীবন। (আবারো কমিটমেন্ট)।
মেয়েটা আদুরে বেড়ালের মতন কল্পনায় আপনার বুকের ভেতর নির্ভরতার উষ্ণতা খুঁজবে, আশ্রয় খুঁজবে। তার বিষাক্ত তিক্ত অতীত ফেলে এসে একটা আলো ঝলমলে নতুন দিনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে সেও হয়তো ফিসফিস করে বলবে, ‘আমাকে কখনো কষ্ট দিও না। কক্ষনো না’।
একটা নতুন সম্পর্কের সূচনা।
এই অবধি ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে। মেয়েটির অতীতে ঘটে যাওয়া সেই বিদঘুটে ঘটনা, সেই ভয়াবহ অন্যায় আচরণের চরিত্রের প্রাক্তন প্রেমিক ছেলেটিও হয়তো তখন একইভাবে অন্য কোন মেয়ের কাছে তার ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের গল্প বলে হাউমাউ করে কাঁদছে। সেই কান্নায় তার ওই প্রাক্তন প্রেমিকা মেয়েটির মত করে সেও তার ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের কথা বলছে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তার এই গল্পের ভিলেন চরিত্রটিই কিন্তু ওই মেয়েটি। ছেলেটির বক্তব্যে ওই মেয়েটিই তাদের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কারণ, ওই মেয়েটিই তার প্রতি অসংখ্য অন্যায় আচরণের কারণ, অবিশ্বস্ততার কারণ। ছেলেটির এই বক্তব্যজুড়ে তাদের সেই ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের প্রায় সকল নেতিবাচক ঘটনার কারণ কী অদ্ভুতভাবেই না সেই মেয়েটি।
ঠিক মেয়েটি যেমন আপনার কাছে ছেলেটিকে অসংখ্য অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। প্রেমিক ছেলেটিও কিন্তু একইভাবে মেয়েটিকে দাঁড় করাচ্ছে অভিযোগের কাঠগড়ায়। তার সেইসকল গল্প শুনে অন্য কোন মেয়ে হয়তো আবার আর্দ্র হয়, ভালোবাসে, কমিটেড হয়।
এই গল্পগুলো আমার জানা। হয়তো জানা আমাদের সকলেরই। এই অবধি যতগুলো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া কাপল দেখেছি, তাদের কাউকে কখনও বলতে শুনি নি যে, ‘আমার কারণে সম্পর্ক ভেঙে গেছে। আসলে ওকে আমার ভাল্লাগছিল না, আমি অন্য একটি মেয়ের/ছেলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, বা অন্য কোন কারণ ছিল, যেই কারণে আমি ওকে ছেড়ে এসেছি। ছেড়ে আসার আগে দায়ভার ওর কাঁধে চাপাতে নানান অভিযোগ করেছি, বাহানা করেছি, বাহান করে ছেড়ে এসেছি’...
এমন কথা কারো কাছে শুনি নি।
বারবার গল্পটা যার কাছে শুনেছি, আবিস্কার করেছি, একমাত্র তার কারণেই টিকে ছিল সম্পর্ক, কিন্তু ভেঙে গেছে অন্য জনের ভয়াবহ অন্যায়ে, অত্যাচারে, অবিশ্বস্ততায়, অসহনীয় আচরণে। কেবল প্রেমের ক্ষেত্রেই নয়, ঠিক একইরকম, একদম হুবহু একই ঘটনা শুনেছি যেসকল বিবাহিত দম্পতির ডিভোর্স হয়ে গেছে, তাদের কাছেও, অন্যজনের সম্পর্কে! গল্পটি যিনি বলছেন, তিনি সবসময় নির্দোষ, দোষী অন্যজন।
হয়তো এটিই স্বাভাবিক। মানুষ তার নিজের দোষ সহজে ধরতে পারে না। সে সবসময় অন্যের দোষ ধরে বেড়ায়। এটি হয়তো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু এই নিজের দোষ এড়িয়ে যাওয়া সম্পর্কের জন্য ভয়াবহ এক ব্যধি। এই ব্যাধি ধীরে ধীরে সম্পর্কটাকে ঘুণপোকার মত কুড়েকুড়ে খেয়ে ফেলে নিঃশেষ করে দেয়।
তারপরও বোধদয় হয় না, সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়, কিন্তু দোষারোপের অধ্যায় শেষ হয় না। সম্পর্ক ভেঙে গেলে, এই কাদা ছোড়াছুড়ি তখন ঘর থেকে ছড়িয়ে পরে বাইরে।
শুরু হয় খানিক আগে বলা ওই ভেঙে যাওয়া কাপলদের ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের মতই, নানান গল্প বলে সহানুভূতি আশ্রয়ী নতুন সম্পর্ক, নতুন কমিটমেন্ট! মজার ব্যাপার হচ্ছে এই নতুন সম্পর্ক শুরুর কিংবা কমিটমেন্টের যে নতুন অধ্যায় শুরু হল, তা কিন্তু খানিক এদিক সেদিক হলেও আগের ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের শুরুর গল্প, কমিটমেন্টের চেয়ে খুব বেশি আলাদা কিছু নয়। বরং একই।
এখানেই কমিটমেন্ট দিয়ে যে ভালোবাসার সম্পর্ক শুরু, সেই ভালোবাসার সম্পর্কে কমিটমেন্ট করার কিংবা রাখার মুহূর্তগুলো খুব ইম্পরট্যান্ট। ছেলেটি কিংবা মেয়েটি সেই গভীর রাতে, এক নিঃসঙ্গ অন্ধকারে মিশে গিয়ে, বুকের ভেতর অদ্ভুত বিষণ্ণতা পুষে রেখে, ঠিক ওই মুহূর্তে একটি ছেলে/মেয়ের অদ্ভুত ভালোলাগার, আশ্রয়ের , আস্থার কণ্ঠস্বর পেয়ে যেভাবে মুহূর্তেই মনে হয়, ‘আমি এই মানুষটাকে কখনোই কষ্ট দেব না, কখনোই ছেড়ে যাব না, সাড়া জীবন থৈথৈ ভালোবাসায় বুকের ভেতর আগলে রাখব, কিন্তু পরদিন দিনের ঝলমলে আলোয়ই হয়তো রাতের সেই কথা, সেই অনুভূতি পলকা মনে হতে পারে। মনে হতে পারে অগভীর কিছু। মনে হতে পারে, ধুর, ওই মুহূর্তে কি না কি বলে ফেলেছি! ইশ, কেন যে এমন করলাম!
একটা কাঁটা বেঁধার মতন অস্বস্তিকর অনুভূতি। কিন্তু সেই কাঁটা বেঁধার মতন অস্বস্তিকর অনুভূতি বা রিয়ালাইজেশনটা তখন সাহস করে বলা হয়ে ওঠে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তখন সেই বিঁধে যাওয়া অস্বস্তি, দ্বিধার কাঁটা নিয়ে সম্পর্কটা চলতেই থাকে।
একটা দ্বিধার ‘কমিটমেন্টের’ প্রস্তরে ভিত্তি গেড়ে গড়ে ওঠে আরও একটি ভালোবাসার সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের পরিণতি কী কে জানে!
তার মানে কিন্তু ওই বিশেষ মুহূর্তে বলা কথাগুলো মিথ্যে ছিল এমন নয়। ওই বিশেষ মুহূর্তে ওই ছেলেটি, ওই মেয়েটি যে কথাগুলো, যে কমিটমেন্টগুলো দিয়েছিল, তা হয়তো সত্যিই ছিল, ওই মুহূর্তে তারা অমনটাই অনুভব করেছিল। কিন্তু ওই একটামাত্র মুহূর্তই পুরোটা জীবন নয়। জীবন এমন অজস্র, অসংখ্য আরও নানান বিশেষ এবং অ-বিশেষ মুহূর্তের সমষ্টি। সুতরাং ওই মুহূর্তের ওই কমিটমেন্ট, ওই অনুভূতি অন্যকোন আরও বিশেষ বা আরও প্রগাঢ় মুহূর্তের তীব্রতায় ভেসে যেতে পারে। হয়ে যেতে পারে আরও একটি সম্পর্ক ভাঙার গল্প। আরও একটি বিট্রেয়ালের গল্প, আরও একটি অভিযোগের, বিচ্ছিন্নতার, কাদাছোড়াছুড়ির গল্প। এই গল্পরা হয়তো চলতেই থাকে। চলতে চলতেই কেটে যায় একটা জীবন!
তাহলে?
তাহলে, সম্পর্ক ভাঙ্গা এবং গড়াটাই কী সহজ এবং স্বাভাবিক? বিশেষ মুহূর্তের স্পর্শে, গভীরতম আর্দ্রতায় দুম করে কমিটমেন্ট, দুম করে ভালোবাসি বলে ফেলা, তারপর আবার অন্যকোন মুহূর্তের আরও তীব্রতম স্পর্শে সেইসব কিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন কোন সম্পর্কের গল্প লেখাটাই কি স্বাভাবিক?
এ খুব দ্বিধান্বিত প্রশ্ন। মানুষ যুগে যুগে সবচেয়ে বেশি যা ভয় পেয়েছে, তার নাম ‘নিজ’। সে তার নিজেকে, নিজের ভেতরের অনুভূতি, ভাবনাকে সে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছে। নিজের ভেতরের প্রবৃত্তিকে। সে তার ভেতরের অদ্ভুত অদ্ভুত সব অনুভূতি, ইচ্ছেকে আলগোছে পাশ কাটিয়ে গেছে, প্রকাশিত হবার ভয়ে। অন্যরা জেনে ফেলবার ভয়ে। কিংবা সেই অনুভূতিগুলো এমনি বিদঘুটে, এমনি কিম্ভুত, এমনই অশ্লীল, ‘অস্বাভাবিক’ যে সে সেই অনুভূতি তার ভেতরে ধারণ করে, টের পায়, এটি সে কোনভাবেই স্বীকার করতে চায় নি, চায় না। সে ভয় পায়। এই অনুভূতি প্রকাশের সাহস তার নেই। হয়তো এইজন্যই অনুভুতির তীব্রতম স্পর্শ না নিয়েও কত সহস্র যুগলজীবন কেটে যায়। সেই কেটে যাওয়া যুগলজীবনজুড়ে ভেসে বেড়ায় চাপা দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়তো পাশের মানুষটিও শুনছে। কিন্তু কেউ কেউ তা শুনে অশান্তি বাড়ায়, কেউ কেউ তা না শোনার ভান করে। এই ভানের গল্পরা চলতেই থাকে।
এ এক অদ্ভুত ভানের জীবন! এই জীবন নিয়েও হয়তো একটা সুন্দর চমৎকার ভানহীন জীবনের নিখাদ গল্প হয়তো বলাই যায়, কিন্তু দিন শেষে সেই গল্পগুলোর ‘হয়তো’ ‘প্রায়’ সকলই হয়ে রয় ফেইরি টেল!
কিংবা হয়ে রয় দায়বদ্ধতা, দায়িত্বশিলতা, রেস্পন্সিবিলিটির গল্প। কে জানে, হয়তো মানবজীবনে আর সকল অনুভূতির চেয়ে সম্পর্কের সুতো গাঁথায়, নিরবচ্ছিন্ন রাখায় এই ‘বোধ’টিই সবচেয়ে বেশি জরুরী। সবচেয়ে বেশি কার্যকর।
জগতের অসংখ্য ভালবাসাহীন সম্পর্ক কেবল এই দায়বদ্ধতায় সওয়ার হয়েই টিকে রয়।
এই রেস্পন্সিবিলিটি বা দায়বদ্ধতার বোধের ভেতর থেকেই হয়তো ক্ষণে ক্ষণে, সময়ে অসময়ে উঁকি দিয়ে যায় ভালোবাসা, মমতা, মায়া। আর মায়া? এই মায়াই কি জগতের সকল হিসেব নিকেশের উৎস? কে জানে! মাঝে মাঝে আমার তাই মনে হয়, কী অদ্ভুত এক ব্যাপার, মায়া মানে মমতা, কী সুতীব্র অনুভূতির নাম। আবার এই মায়া মানেই বিভ্রম, কুহেলিকা, ইংরেজীতে এই মায়াকেই আমরা বলি ইল্যুশন, বিভ্রম। কী অদ্ভুত!!
আর মায়া, মমতা, ভালবাসাহীন বাদবাকী অনুভুতিহীন সময়গুলোতে সম্পর্কের মরে যেতে থাকা চারা গাছে জল ঢেলে জিইয়ে রাখে এই দায়বদ্ধতা, ছিঁড়ে যেতে থাকা সুতো জোড়া দিয়ে যায় এই রেস্পন্সিবিলিটির বোধ!
এ সম্পর্কের এক অদ্ভুত সমীকরণের, এক অদ্ভুত হিসেবের গল্প।
০২.
মেয়েটা চলে যাচ্ছে। এমন করে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল না। ছেলেটা হাউমাউ করে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘তুমি বলেছিলা, তুমি কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবে না। কখনোই না। যদি কখনো আমাকে ছেড়ে চলে যাও, তবে পৃথিবীটা সেদিন উল্টে যাবে’।
মেয়েটা কথা বলে না। ছেলেটা হাউমাউ করে কাঁদে। কাঁদতেই থাকে। কাঁদতে কাঁদতে সে কতকিছু ভাবে। কত কত স্মৃতি, কত কত মুহূর্ত, কত কত কমিটমেন্ট!
মেয়েটা সেই কান্নায় সত্যি সত্যি দ্রবীভূত হয় কি না বোঝা যায় না। তবে সে খানিকটা গভীর ভেজা গলায় বলে, ‘আর কোন উপায় ছিল না। তুমিতো জানো, আমার আর কী করার ছিল! তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার খুব কষ্ট হবে, খুব। আমি তোমাকেই ভালোবাসি। কিন্তু বিয়েটা আমাকে করতেই হচ্ছে’।
ছেলেটা কথা বলে না। তার বুকের ভেতর আবারও কষ্ট দলা পাকায়। তবে সেই কষ্টে খানিক ভালো লাগাও যেন আড়ালে আবডালে কোথায় উঁকি মারে। মেয়েটা তাহলে তার সাথে প্রতারণা করে নি। সে পরিস্থিতির শিকার। পরিস্থিতি , পরিবার তাকে বাধ্য করছে অন্য কাউকে বিয়ে করতে। কিন্তু সে ভেতরে ভেতরে আসলে তাকেই ভালোবাসে!
ছেলেটার খুব সামান্য, ধরতে না পারার মত খুব সামান্য হলেও ভালো লাগে। কিন্তু কষ্টরা আরও গাঢ় হয়। আরও কান্না পায়। মেয়েটাও কাঁদে। তারা পরস্পরকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্টে কাঁদে। কিন্তু সেই কান্নার কার কতটুকু আসলেই কান্না, আসলেই অসহনীয় কষ্ট পুষে রাখতে না পারার নির্ভেজাল কান্না, কে জানে?
আসলেই কেউ জানে না। ‘জগতের যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে চাই, তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারব না’ এমন কমিটমেন্টগুলো জানে না। একান্ত মুহূর্তগুলো জানে না। জানে না, অসংখ্য, রাত দিনের গল্পরাও, জানে না মোবাইল ফোন, ফেসবুকের কত শত, সহস্র মিনিট, ঘন্টা, মেগাবাইটের হিসেবেরাও।
এই গল্পের ছেলে বা মেয়ে আলাদা কেউ নয়। গল্প ভেদে চরিত্র বদলে যেতে পারে। কিন্তু যা বদলায় না তা হল, ভালোবাসা, অনুভূতি, আবেগ আর ঘটে যাওয়া ঘটনার হিসেব।
এক জনমে এমন বহু কান্না দেখেছি। হয়তো কেঁদেছিও। সেই কান্নার ফোটা ফোটা জল, বিনিদ্র রাতেরা একটা সময় একটা অদ্ভুত কঠিন সত্য বলে গেছে কানের কাছে, বুকের কাছে। সেই সত্য, ‘এখানে কেউ কারো জন্য থাকে না। সকলেই থাকে কেবলই নিজের জন্য... যতক্ষন নিজের ভালো লাগে, কারো কাছে থাকতে না পারলে বুকের ভেতর হাহাকারের তুমুল হাওয়া কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে দেয়, ততক্ষণ কেবল কেউ কারো জন্য থাকে। কিন্তু সেই অনুভুতিরা যে মরে যেতে থাকে, বিবশ হতে থাকে, পল্কা হতে থাকে, যখন কারো জন্য কারো বুকের ভেতর হাহাকার জাগে না, কান্না কান্না লাগে না, বুকের ভেতর কেঁপে কেঁপে ওঠে না, তখন ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে সাথে না থাকার বাসনা। এই বাসনা ভয়ঙ্কর। এই না থাকতে চাওয়ার বাসনা, অনুভুতিহীনতা নিয়েও থেকে যাওয়া বরং সম্পর্কের মৃত্যু কিংবা মৃত সম্পর্কের পচে গলে যাওয়া লাশ বয়ে বেড়ানো।
তাহলে কে থাকে? শর্তবিহীন? দুঃখে, আনন্দে, বিষাদে, হর্ষে? কেউ কি থাকে?
হ্যাঁ থাকে।
কে?
কেবল নিজে। কেবল নিজেই থাকে নিজের সঙ্গে। সে কখনও নিজেকে ছেড়ে যায় না। সুতরাং সেই একটা নিজেকে গড়ে তুলতে হয় প্রবল কঠিন করে, বিশাল বিস্তৃত করে, যাতে সে ছায়াময় হয়ে উঠতে পারে। ঘোর বিপদে, বিষণ্ণতায় তার ভেতর ডূবে যাওয়া যেই। এই স্বত্বাটি ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়। নিজের ভেতর। সে তখন ভেঙে পড়া স্বত্বাটাকে গভীর মমতায়, আশ্বাসে, আশ্রয়ে আগলে রাখে।
খুবই অদ্ভুত কথা। ‘নিজ’ কি দুটো স্বত্বা? যে একটা আরেকটার সাথে থাকবে।
হ্যাঁ, ‘নিজ’ দুটো স্বত্বাই। কিংবা দুটো না তার চেয়েও আরও অনেক বেশি।
কী অদ্ভুত।
হ্যাঁ অদ্ভুত। কিন্তু সত্যি।
কিভাবে?
যেসব মানুষ দুম করে সুইসাইড করে বসে তাদের মধ্যেও কিন্তু একাধীক স্বত্বা থাকে, তাকে বলতে থাকে,সুইসাইড করো না, না, না। সে নানান যুক্তি দিতে থাকে। সুইসাইড না করার পক্ষের যুক্তি। আরেকটা স্বত্বা থাকে, সে বলতে থাকে, সুইসাইড করে ফেলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে নানান যুক্তি দিতে থাকে। এই দুইতরফেই চলতে থাকে যুক্তির খেলা। সেই খেলায় যে জেতে, সেই সফল হয়।
বেঁচে থাকা বা মৃত্যু। আত্মজীবন বা আত্মহনন।
এখানে সেই স্বত্বাটাই জেতে, যাকে আপনি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, অসংখ্য অজস্র ঘটনায়, চেতনে , অবচেতনে লালন করেছেন, শক্তিশালী করেছেন, বাড়িয়ে তুলেছেন। অনেক ছোট ছোট ঘটনায়। অনেক বড় বড় ঘটনায় আপনি আপনার কোন ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, কখনও ভেবে দেখেছেন? সেই প্রাধান্য দেয়া ভাবনাগুলোই কিন্তু আপনার দুঃসময়ে আপনার পাশে থাকবে।
সমস্যা হচ্ছে, এমন নানা ঘটনায় আপনি যদি নেতিবাচক ভাবনাগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন, তবে আপনার দুঃসময়ে আপনার সেই নেতিবাচক ভাবনাগুলো এসে আপনার পাশে দাঁড়াবে। আর তারপর? তারপর আপনার অসহায়ত্বকে আরও প্রবল অসহায়ত্বে পরিণত করবে। আপনার দুঃসময়কে আরও প্রলম্বিত করবে। ধ্বংসাত্মক করবে। কিন্তু আপনি যদি এতোদিনকার ঘটনাগুলোয় চেতনে অবচেতনে ইতিবাচক ভাবনাগুলোকে লালন করে, তারাও এই দুঃসময়ে আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে।
এই ইতিবাচক আর নেতিবাচক ভাবনাগুলো আসলে কী? আশা করছি সবাই মোটামুটি বুঝতে পারছেন। না পারলেও পরবর্তী কোন লেখায় এই বিষয়ে আমি আমার ভাবনা শেয়ার করব।
তার আগে একটা কথা।
আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। থাকতে পারব না। আসলেই কী তাই? জগতে কী কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না? মৃত সন্তানকে ছেড়ে বাবা মা? পারেন না? নিশ্চয়ই পারেন। সেই পারা তীব্র কষ্টের। কিন্তু সেই কষ্টও ধীরে ধীরে খানিকটা করে আড়াল হতে থাকে। থাকে না? থাকে।
আসলে, ‘নাথিং ইজ ইমপারেটিভ ইন লাইফ’। জীবনে অপরিহার্য বলে কিছু নেই। যখনি কেউ বুঝে যাবে আপনার জীবনে সে অপরিহার্য তখনই আপনি হেরে গেলেন। একটি গভীরতম ভালোবাসার সম্পর্ক সেই মুহূর্তে হয়ে গেল অসম, পরাশ্রয়ী এবং পরনির্ভরশীল। সম্পর্কে ‘নির্ভরশীলতা’ খুবই দরকারি, কিন্তু এই বিশেষ 'পরনির্ভরশীলতা’র বেশির ভাগই সম্পর্কটাকে দুর্বল করতে শুরু করে।
তাহলে?
সম্পর্কের ভালো সময়টাতে হয়তো আপনি তা বুঝতে পারবেন না। বুঝতে পারবেন খানিক খারাপ সময়ে। দেখবেন কী কদাকার হয়ে উঠছে এই পরনির্ভরশীলতা!
তাহলে আবারও সেই একই কথা, নির্ভরশীল হতে হবে নিজের উপর। নিজের ভেতরে একটি শক্তিশালী স্বত্বা গড়ে তুলতে হবে, যে একলা থাকার ভয়াবহ দুঃসময়ে পরম মমতায় আগলে রাখবে আপনাকেই। স্বপ্ন দেখাবে নতুন দিনের, নতুন সম্ভাবনার। আপনার বুকের ভেতর শক্তি জোগাবে। সাহস জোগাবে। ধ্বংসের, মৃত্যুর, দুঃসময়ের ভয়ঙ্করতম ধ্বংসস্তূপ থেকেও সে আপনাকে জাগিয়ে তুলবে নতুন স্বপ্নে, সম্ভাবনায়, জীবনে।
পুড়ে যাওয়ার ছাই থেকে পাখীর পুনর্জন্মের মতন।
নিজের ভেতরের সেই শক্তি জাগিয়ে তুলবে আপনাকেই, আপনাকেই তৈরি করতে হবে আপনাকে, আপনিই তৈরি করবেন। আপনার জীবনেই শুরু হবে আপনার লেখা অন্য এক পাখীর গল্প।
No comments:
Post a Comment